শামীম রাহমান:
হাইস্পিড ট্রেন চালানোর জন্য প্রয়োজন বাধাহীন রেলপথ। দরকার বিদ্যুৎ চালিত ইঞ্জিন (ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন)। দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর লাইনটিও হতে হয় স্ট্যান্ডার্ড গেজের। এর কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও ঢাকা-চট্টগ্রামে বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনে হাইস্পিড ট্রেন চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে এডিবির এ প্রস্তাবকে ‘অসম্ভব’ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবটি দেন বাংলাদেশে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন পারকাশ। সাক্ষাৎ শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এডিবির প্রতিনিধি মনমোহন পারকাশ জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিদ্যমান রেললাইনেই দ্রুতগতির রেল পরিবহন পরিচালনা করা সম্ভব। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এডিবি জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের একটা সমীক্ষাও করা আছে।
এডিবি এ প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘তাদের প্রস্তাবের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে।’ পরে বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়েতে খোঁজ নেয়া হলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিদ্যমান রেলপথটির ডিজাইন স্পিড ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। এ রেলপথ দিয়ে বর্তমানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে। রেলপথটি হাইস্পিড ট্রেন চালানোর জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়।
হাইস্পিড ট্রেনের জন্য সাধারণত স্ট্যান্ডার্ড গেজের রেলপথ দরকার হয়। স্ট্যান্ডার্ড গেজে দুটি লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১ হাজার ৪৩৫ মিলিমিটার বা ৪ দশমিক ৭ ফুট। মিটার গেজে দুই লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র ১ হাজার মিলিমিটার বা ৩ দশমিক ২ ফুট। ঢাকা-চট্টগ্রামের এ মিটার গেজ রেলপথেই হাইস্পিড ট্রেন চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে এডিবি। অন্যদিকে ব্রড গেজে দুই লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১ হাজার ৬৭৬ মিলিমিটার বা ৫ দশমিক ৬ ফুট। রেলওয়ের পশ্চিম জোনে এ গেজের রেলপথ বেশি রয়েছে। রেলওয়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিটার গেজ লাইনে কোনোভাবেই হাইস্পিড ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা বলছেন, কমলাপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলক্রসিং, রেললাইনের পাশের নানা অবৈধ স্থাপনা ও মানুষ চলাচলের কারণে ট্রেনগুলো বেশি গতি তুলতে পারে না। এ অংশটি পার হতেই একটি ট্রেনের ১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রয়েছে আরো একাধিক রেলক্রসিং। পাশাপাশি অনেকগুলো কার্ভ (বাঁকানো রেলপথ) রয়েছে, যেগুলো ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়। দ্রুতগতির ট্রেন এসব বাধার সম্মুখীন হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রামের বিদ্যমান রেলপথে হাইস্পিড ট্রেন চালানো সম্ভব কিনা—জানতে যোগাযোগ করা হয় পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হকের সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাইস্পিড ট্রেনের জন্য দরকার অ্যাকসেস কন্ট্রোল রেলপথ। অর্থাৎ এমন একটি রেলপথ, যাতে ট্রেন চলাচলে কোনো বাধা থাকবে না। অ্যাকসেস কন্ট্রোল ও লেভেল ক্রসিংগুলো যদি আলাদা করা সম্ভব হয় এবং কার্ভ (বাঁকানো) অংশগুলো সোজা করা যায়, তাহলে হয়তো এ রেলপথে ট্রেনের গতি কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু হাইস্পিড ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। এর জন্য আলাদা রেলপথ দরকার হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে রেলওয়ের ইলেকট্রিফিকেশনের কথা বলা আছে। এরপর বলা আছে অ্যাকসেস কন্ট্রোল করিডোরের কথা। আমরা যেখানে বৈদ্যুতিক ট্রেনই আনতে পারিনি, সেখানে ঢাকা-চট্টগ্রামের মিটার গেজ লাইনে কীভাবে হাইস্পিড ট্রেন চালাব? যারা প্রস্তাবটি দিচ্ছে, যদি উদ্যোগটি ব্যর্থ হয় তার পুরো দায়ভার তাদেরই নিতে হবে—প্রকল্পটি করার আগে এ ধরনের চুক্তি করে নেয়া উচিত।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান মিটার গেজ লাইনের দূরত্ব ৩২১ কিলোমিটার। রেলওয়ের অপারেশন শাখার তথ্য বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের ট্রেনগুলো চলাচল করতে সময় নেয় সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। এ রুটে হাইস্পিড ট্রেন চালুর লক্ষ্যে বর্তমানে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে, চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন ও মজুমদার এন্টারপ্রাইজ (বাংলাদেশ) যৌথভাবে সম্ভাব্য সমীক্ষার কাজ করছে।
জানা গেছে, হাইস্পিড ট্রেন চালুর জন্য আলাদা লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন লাইনটি হবে বিদ্যমান লাইনের চেয়ে প্রায় ৯০ কিলোমিটার কম। পুরোপুরি অ্যাকসেস কন্ট্রোল লাইনটি দিয়ে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের চলমান সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রামের বিদ্যমান লাইনে হাইস্পিড ট্রেন চালানোর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছে এডিবি। প্রস্তাবটি এডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে রেলপথ মন্ত্রণালয় বা রেলওয়েতে দিয়েছে কিনা, জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা এডিবির কাছ থেকে এমন কোনো প্রস্তাব পাইনি।
রেলওয়ের মহাপরিচালকও মনে করেন, ঢাকা-চট্টগ্রামের মিটার গেজ লাইনে কোনোভাবেই হাইস্পিড ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। বিদ্যমান লাইনটি হাইস্পিড ট্রেন চালানোর উপযোগী নয়। এজন্য আমরা নতুন একটি লাইন করে হাইস্পিড ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করছি। এ নিয়ে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পও চলমান।
সুত্র:বণিক বার্তা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯