বাংলাদেশ রেলওয়ের ৫৮টি ট্রেন বর্তমানে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এসব ট্রেনে কেবল ব্যবস্থাপনাগত সেবা দেয় সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এবার কোচ ও ইঞ্জিন আমদানির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঢাকা-জামালপুর রুটে ট্রেন পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজেস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। তাদের এ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করছে রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ বেসরকারি ট্রেন সার্ভিস পরিচালনার অনুমতি পেতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে তারা ঢাকা-জামালপুর-ঢাকা রুটে প্রতিদিন পাঁচ জোড়া ট্রেন পরিচালনার অনুমতি চায়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনকে বেজ স্টেশন করে কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে দেওয়ানগঞ্জ বাজার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ও বিকালে উভয় পথে পাঁচ জোড়া ট্রেন সার্ভিসের কথা উল্লেখ করা হয় এতে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক তিন জোড়া ট্রেন তেজগাঁও স্টেশন থেকে পরিচালনার জন্য নিজেদের অর্থে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডা থেকে লোকোমোটিভ এবং চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কোচ সংগ্রহের প্রস্তাব দেয়।
ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ নভেম্বর রেল ভবনে এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের পর চলতি বছরের ৫ মার্চ রেলওয়ে সচিবকে একটি সংশোধিত প্রস্তাব দেয় ইউনাইটেড। প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ট্রেন সার্ভিস পরিচালনায় কয়েকটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি সুবিধাই বাংলাদেশ রেলওয়ে দেবে। ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ শুধু কোচ ও ইঞ্জিন আমদানির মাধ্যমে ট্রেন পরিচালনা করবে। তবে চালক ছাড়াও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষিত কর্মীকে নিয়োগ দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউনাইটেডের দেয়া প্রস্তাব থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি রেলের বর্তমান অবকাঠামোগত সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগের বিলাসবহুল ট্রেন সার্ভিস চালাতে চায়। নিজস্ব রোলিং স্টক (লোকোমোটিভ, প্যাসেঞ্জার কোচ অথবা ডেমু সেট) সংগ্রহ করে ট্রেন পরিচালনা করবে তারা। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী বাহাদুরাবাদ ও জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত রুট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এক্ষেত্রে তারা রেলের বর্তমান অবকাঠামো যেমন— ট্র্যাক, লোকোশেড, ওয়ার্কশপ, সিকলাইন, ওয়াশপিটসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করবে। তবে নিরাপদ ও আধুনিক যাত্রী-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রতিটি স্টেশনে সাধারণ ও প্রিমিয়ার শ্রেণীর দুই ধরনের যাত্রী বসার জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করবে। এজন্য আলাদা যাত্রী শেড ছাড়াও প্লাটফর্ম, এক্সেলেটর সুবিধা, নিজস্ব ওভারব্রিজ নির্মাণ করবে তারা। পাশাপাশি ২২টি করে কোচ-সংবলিত ট্রেন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে চালানোর মাধ্যমে এ রুটে বর্তমানের অর্ধেকেরও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং ২০ শতাংশ স্পেয়ার কোচ ও দুটি ট্রেনের জন্য অতিরিক্ত দুটি স্পেয়ার ইঞ্জিনের প্রস্তাবও দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল উভয় পক্ষের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে রেল ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার জন্য ইউনাইটেড গ্রুপের প্রস্তাবের আইনি দিক ও অপারেশনাল বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উভয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই শেষে রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে।
জানতে চাইলে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের প্রকল্পপ্রধান একেএম শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে রেলওয়েকে। আশপাশের জেলাগুলোর বিপুল সংখ্যক যাত্রী প্রতিদিন রাজধানীতে যাতায়াত করেন। এসব যাত্রীকে স্বল্প খরচে নিরাপদ ও দ্রুত সেবা দেয়ার মাধ্যমে রেল যোগাযোগকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে যাত্রীভাড়া নির্ধারণসহ বেশ ক’টি বিষয়ে এখন পর্যন্ত রেলের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য রয়েছে। এ বিষয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটি সরেজমিন সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে প্রতিবেদন জমা দেবে। এর পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
ইউনাইটেডের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলের গঠিত কমিটির সদস্য ও রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ইউনাইটেডের বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার প্রস্তাবটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। গঠিত কমিটি প্রস্তাবটি সরেজমিন যাচাই-বাছাই ছাড়া এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
বর্তমানে ঢাকা-জামালপুর রুটের রেললাইনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী ট্র্যাক সংস্কার ও উচ্চগতিসম্পন্ন ইঞ্জিন, কোচ মেরামতে রেলওয়েকেও বড় বিনিয়োগে যেতে হবে। এক্ষেত্রে ইউনাইটেড গ্রুপ শতভাগ বিনিয়োগের মাধ্যমে ট্রেন পরিচালনায় নামতে চাইলে সেক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে রেলওয়ে সহযোগিতা করতে পারে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা।
রেলওয়ের টাইম টেবিলের তথ্যানুসারে, ঢাকা থেকে দেওয়ানগঞ্জ বাজার পর্যন্ত সর্বমোট দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার। এ রুটে প্রতিদিন চারটি আন্তঃনগর ও ছয়টি মেইল-এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। ৭০৭ ও ৭০৮ তিস্তা এবং ৭৪৩ ও ৭৪৪ নং ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ছাড়াও ৪৭ ও ৪৮ নং দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার, ৫১ ও ৫২ নং জামালপুর কমিউটার, ৫৫ ও ৫৬ নং ভাওয়াল এক্সপ্রেস নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করে। এর মধ্যে জামালপুর এক্সপ্রেস প্রতি ট্রিপেই ১ লাখ টাকা, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার প্রতি ট্রিপে ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা এবং তিস্তা এক্সপ্রেস প্রতি ট্রিপেই আড়াই লাখ টাকা আয় করে। নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু হলে রেলের চলমান ট্রেনগুলোর যাত্রী কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলিয়ে মোট ৫৮টি ট্রেন বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের ৪৪ ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৪টি ট্রেন লিজ নিয়ে শুধু ব্যবস্থাপনা সেবা বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। অর্থাত্ রেলের নির্ধারিত ভাড়া ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শুধু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেসরকারি মালিকানায় ট্রেনগুলো চলাচল করে। কিন্তু এই প্রথম ইউনাইটেড গ্রুপ রোলিং স্টক ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ট্রেন পরিচালনার সুবিধা চাইছে।