ইসমাইল আলী: লাকসাম-চিনকি আস্তানা রেলপথের ডাবল লাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী রেলপথটি উদ্বোধন করেন। এরপর রেলপথ নির্মাণব্যয় ১৭ কোটি টাকা কমানো হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদও ২০১৬ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ তিন বছর পেরুলেও ঝুলে রয়েছে প্রকল্পটি। উল্টো তৃতীয় দফায় ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্রমতে, ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে জটিলতা না কাটায় দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি অর্থবছর জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল। তবে চলতি অর্থবছরের সম্ভাব্য সমাপ্য প্রকল্পের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের নাম। যদিও একই সময়ে শুরু করা টঙ্গী-ভৈরববাজার রেলপথ ডাবল লাইন প্রকল্পের ব্যয় সম্প্রতি ৩৭ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০০৭ সালে লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক কমিশনের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন করা হয়। ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণে সে সময় ব্যয় ধরা হয় ৫০১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ঠিকাদার নিয়োগের পর প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৫২৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। পরে প্রকল্পের আওতায় কাজের পরিধি বাড়লে দ্বিতীয় দফা প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তখন এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৪৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২০১৫ সালের আগস্টে প্রকল্প ব্যয় সমন্বয় করা হয়। তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর দাম স্থিতিশীল থাকা ও ভ্যাট-কর কমায় প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বিশেষ সংশোধনের নামে সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা কমানো হয়।
এর পর ১০ মাস না যেতেই প্রকল্পটির ব্যয় ৯৫ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। যদিও পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনামতে, স্বাভাবিকভাবে প্রকল্পের তৃতীয় দফা ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন নেই। এজন্য ২০১৬ সালে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মতামত চাওয়া হয়। পুরো প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে আইএমইডি। তাদের মতামতের পরও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করেনি পরিকল্পনা কমিশন। আর দুই বছরে ব্যয় আরও কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এখনো ঝুলে রয়েছে প্রকল্পটি।
প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তিতে বলা হয়, লাকসাম-চিনকি আস্তানা রেলপথ নির্মাণকাজের চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে সম্পাদন করা হয়েছে। ওই চুক্তিতে ফর্মুলা অনুসারে নির্মাণসামগ্রীর বাজারদর হ্রাস/বৃদ্ধির ভিত্তিতে দর সমন্বয় করার শর্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে প্রকাশিত বুলেটিনের তথ্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজের বিল প্রণয়নকালে সাম্প্রতিককালের বুলেটিন প্রকাশিত না হওয়ায় ছয় থেকে আট মাস আগের তথ্য ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, আট মাস পর ২০১৫ সালের আগস্টে বিবিএস নতুন বুলেটিন প্রকাশ করে। এর ভিত্তিতে প্রকল্পটিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। এখন সে অনুসারে নির্মাণসামগ্রীর দাম সমন্বয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) ব্যয় সমন্বয় খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। তাই প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর জন্য ডিপিপি সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন প্রকল্পের পরিচালক কাজী রফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি নয়, মূল্য সমন্বয় করা হয়েছিল। বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত বুলেটিনের ভিত্তিতে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। এছাড়া চুক্তিতে আন্তর্জাতিক চুক্তির মানদণ্ড (ফিডিক) অনুসরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ১৮ মাস পেরুলেই ব্যয় সমন্বয় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য প্রকল্পটির ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
যদিও একই সময়ে শুরু করা টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন প্রকল্পের ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। এক্ষেত্রে ৬৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ২১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রেলপথটি উদ্বোধন করা হয়। ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড শেষে চলতি জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে প্রকল্পের বেঁচে যাওয়া ৩৭ কোটি টাকা সমন্বয়ে তা সংশোধন করতে হচ্ছে। এতে প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ১৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, লাকসাম-চিনকি আস্তানা প্রকল্পটি খুবই সুন্দরভাবে শেষ করা হয়েছিল। কোনো ধরনের অভিযোগ এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠেনি। তবে এখন ফিডিকের শর্ত লঙ্ঘন করলে রেলওয়ের বিরুদ্ধে মামলা করবে ঠিকাদার। তাই বাধ্য হয়েই বর্ধিত অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এজন্য প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। টঙ্গী-ভৈরব বাজার রেলপথ ডাবল লাইন নির্মাণে এ সমস্যা হয়নি। তাই প্রকল্পটির বেঁচে যাওয়া অর্থ সমন্বয় করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, লাকসাম-চিনকি আস্তানা প্রকল্পে অর্থায়ন করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। তবে এখন বর্ধিত ব্যয় বহন করবে না সংস্থাটি। আর টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন নির্মাণে অর্থায়ন করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
সুত্র:শেয়ার বিজ