তাপস কুমার, নাটোর: উত্তরাঞ্চলে রেলের ডাবল লাইন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। নাটোরের আবদুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত সিঙ্গল লাইনে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত ট্রেন চলাচল করছে। এতে উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলরত যাত্রীদের সময় অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচও গুনতে হচ্ছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে ব্রিটিশ রেলওয়ের সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিভিন্ন অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ করা হয়। সে সময়ে প্রধান রেলপথগুলো ডাবল লাইনে নির্মাণ করা হয়, যাতে একটি ট্রেন যাওয়ার সময়ে বিপরীতমুখী ট্রেনের ক্রসিংয়ের জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় না হয়। সে সময় শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা যাওয়ার প্রধান রেলপথ ছিল পার্বতীপুর-সান্তাহার-নাটোর-ঈশ্বরদী-দর্শনা হয়ে কলকাতা। এ রেলপথটি ছিল ডাবল লাইন।
কিন্তু ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে আবদুলপুর থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত একটি লাইন তুলে নেয়। ফলে সিঙ্গল লাইনের কারণে একটি ট্রেনকে অন্য একটি ট্রেনের অতিক্রমের সময় স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এতে প্রচুর সময়ের অপচয় হওয়ায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
বর্তমানে পার্বতীপুর থেকে সান্তাহার-নাটোর-ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। সড়কপথের ঝুঁকি ও ভোগান্তির কারণে মানুষ ট্রেনের প্রতি দিন দিন আগ্রহী হচ্ছে। কিন্তু সিঙ্গল লাইনের কারণে ট্রেনগুলো সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারায় অনেকেই ট্রেনের প্রতি বিরূপ হচ্ছেন। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় পার্বতীপুর থেকে ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত এবং আবদুলপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত লাইনসহ প্রধান রেলপথগুলো ডাবল লাইনে রূপান্তরের জন্য যাত্রীরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি করে আসছেন।
আকাশ চক্রবর্তী নামে এক যাত্রী জানান, ট্রেনের একক লাইনের কারণে ট্রেন আসতে দেরি হয়। অনেক সময় বসে থাকতে হয়। যদি ডাবল লাইন থাকত তাহলে ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ত, যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হতো না। সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পেত।
আবদুলপুর জংশনের স্টেশনমাস্টার সাইফুল ইসলাম জানান, রেলের আধুনিকায়নের জন্য উত্তরাঞ্চলে ডাবল লাইনের বিকল্প নেই। যমুনা সেতু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। রেলের ডাবল লাইন হলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির আরও এগিয়ে যাবে। রেলের ডাবল লাইন না হওয়ার কারণে ঠিকমতো যাত্রীসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কোনো স্থানে ট্রেন লাইনচ্যুত হলে পুরো রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডাবল লাইন থাকলে বিকল্প হিসেবে অন্য আরেকটি লাইন ব্যবহার করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটা হয়ে উঠছে না।
নাটোর রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার অশোক কুমার চক্রবর্তী জানান, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দুই লেনের রেললাইন স্থাপন করে। কিন্তু পরে পাকিস্তান সরকার নাটোরের আবদুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত একটি লাইন উঠিয়ে সিঙ্গল লাইন করে। বর্তমানে সিঙ্গল লাইনে যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত ট্রেন উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানী এবং দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করছে। কিন্তু ট্রেনের লাইন ডাবল না থাকায় প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। সিঙ্গল লাইনের কারণে এক স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে অপর ট্রেনটি পাসিং করছে রেলওয়ে বিভাগ। এতে ট্রেন বিলম্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত জ্বালানি খরচও গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। সময় অপচয়ের পাশাপাশি সময়মতো গন্তব্যস্থানে যাত্রীদের নিয়ে পৌঁছাতে পারছে না ট্রেনগুলো। সময় অপচয়, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ কমানোসহ সব সমস্যা সমাধানের জন্য ডাবল লাইনের বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ জানান, উত্তরাঞ্চলে রেলের যাত্রী ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে আবদুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনের ডাবল লাইন নির্মাণের বিষয়টি সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন। সে সময় রেলমন্ত্রী মজিবুল হক সংসদকে জানিয়েছিলেন, আগামী ২০১৯ সালের মধ্যে ডাবল লাইন করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। তিনি বিষয়টি আবার সংসদে উপস্থাপন করবেন। আবদুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত রেলওয়ের ডাবল লাইন নির্মাণ করা হলে যাত্রী ভোগান্তি অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি রেলের রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে।