সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত:
১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের প্রধান লর্ড ডালহৌসী স্বহস্তে একটি চিঠি লিখে ইংল্যান্ড সরকারকে জানায় পাল্কি, ঘোড়া, নৌকা দিয়ে এই বিশাল দেশকে আর শাসন করা যাবে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। সেজন্য চাই ভারতে রেল ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই ব্যবস্থা যত দ্রুত হবে সারা ভারতবর্ষ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে। ব্রিটিশ সরকার লর্ড ডালহৌসীর এ চিঠি পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ভারতে রেলব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ইংল্যান্ডেই তৈরি হবে এবং ডালহৌসীকে জানানো হয় কোন পথে কিভাবে রেল পরিষেবা চালু করা হবে। ডালহৌসী উত্তরে জানান যেহেতু বাংলায় তারা প্রথম শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে, তাই বাংলা থেকেই প্রথম রেল ব্যবস্থা শুরু করা যেতে পারে। ডালহৌসী ইংল্যান্ডকে আরও জানিয়েছিল- কোলকাতা থেকে হুগলি এই ৩৪ কিলোমিটার রাস্তায় প্রথম ট্রেন চলবে এবং এই জন্য ট্রেনের ইঞ্জিন ও কোচ ইংল্যান্ডেই তৈরি হবে এবং জাহাজে করে তা কোলকাতায় আসবে, যে পথে জোব চার্নক এসেছিল। দিল্লির রেল ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে এ নথি সংরক্ষিত আছে। এমনকি ডালহৌসীর হাতে লেখা চিঠিটিও। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকার কোলকাতা ও হুগলির মধ্যে জমি জরিপ করে জমিও চিহ্নিত করে। না, শেষ পর্যন্ত কোলকাতা ও হুগলির মধ্যে ১৮৪৮ সালে ট্রেন চলাচল করা গেল না। ভারতে প্রথম রেল চালু হলো বম্বে ও থানের মধ্যে। কিন্তু কেন হলো না, তা বাংলার কাছে দুর্ভাগ্যের বিষয়।
আসলে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড থেকে জাহাজে করে বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ও ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট কোলকাতার দিকে আসছিল। সেই জাহাজ দুটি পথ ভুল করে অষ্ট্রেলিয়ায় চলে যায়, তা ঘুরিয়ে আনতে প্রায় ৩ বছর সময় লেগে যায়। আর বম্বে-থানের জন্য ইঞ্জিন ও কম্পার্টমেন্ট আগেই পৌঁছে যায়। ফলে বম্বে-থানেতেই এ দেশের রেল প্রথম চালু হয়। এই সময় কোলকাতা ও হুগলির মধ্যে রেললাইন পোঁতার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। এ এক লম্বা ইতিহাস। রেলের তথ্য ঘেটে দেখা যাচ্ছে, কোলকাতা ও হগলীর মধ্যে রেল চলাচলের ব্যাপারে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী মানুষ প্রবল বিরোধিতা করেন। তারপর আর থেমে থাকেনি। প্রথমে ন্যারোগেজ, তারপর ব্রডগেজ ট্রেন চালু হলো। তা এখন দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ সরকার দুই বাংলায় নানা ধরনের ট্রেন চালু করে। বাংলাদেশের আখাউড়ায় একটি বড় জংশন স্টেশনও করা হয়। কোলকাতা থেকে আসাম পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করে বহু গবেষণার পর ব্রডগেজ লাইনে ৬০ মাইল অর্থাত্ ৯৬ কিলোমিটার গতিতে স্বাধীনতার আগেই ট্রেন চলতে শুরু করে।
কিন্তু রাজধানী দিল্লির সঙ্গে কোলকাতার প্রথম ট্রেন চালু হয় ১৯৬৯ সালে। এই মার্চ মাসেই। সম্প্রতি রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘রাজধানী’ চালু হওয়ার সময় তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। ১৯৬৯ সালের ৩ মার্চ পূর্বরেল এই রাজধানী এক্সপ্রেস প্রথম চালু করে। এটিই ছিল ভারতের প্রথম সুপার ফাস্ট ট্রেন। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঐ ট্রেনের গার্ড ছিল এসও লেভি (S.O LEVY) আর ড্রাইভার ছিল জিএল টোচার (G.L TOCHER)। এরপর থেকেই বিভিন্ন রাজ্যের সদর দপ্তর থেকে রাজধানী অর্থাত্ দিল্লিতে এই ট্রেন চালু করা হয়। উদ্দেশ্য দেশের রাজধানীর সঙ্গে দ্রুত এবং সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন। ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বাঙালি রেলমন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরী কোলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে আর একটি ‘রাজধানী’ এক্সপ্রেস চালু করেন। সেটি শিয়োলদা ও দিল্লির মধ্যে। হাওড়া-দিল্লির মধ্যে ‘রাজধানী’ এক্সপ্রেস তো আগেই চালু হয়েছে। শুধু শিয়ালদা-দিল্লি নয়, তিনি চালু করেছিলেন আসামের রাজধানী গৌহাটি থেকে দিল্লিতে রাজধানী এক্সপ্রেস। এখন অহরহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু তিনি তার সময় স্লোগান দিয়েছিলেন Safely, Security and Punctuality অর্থাত্ নিরাপদে, নিরাপত্তা ও সময়ানুবর্তিতা। কোলকাতা রাজধানী এক্সপ্রেসে বর্তমানে ২০টি কোচ আছে। এর মধ্যে ২টি এসি, ফার্স্ট ক্লাস, ৫টি এসি টু-টায়ার ও ১০টি এসি থ্রি-টায়ার। এছাড়া আছে একটি প্যান্ট্রি কার (Pantry Car) এবং ২টি কার কাম লাগেজ (Car Cum Luggage)। বাংলাদেশ থেকেও বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ কোলকাতা এসে আজমীর শরিফে যাওয়ার জন্য এই রাজধানী এক্সপ্রেসে যাতায়াত করে থাকেন। সম্প্রতি হাওড়া রাজধানীর ৫০ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, কোলকাতা-দিল্লির মধ্যে এক হাজার ৪৪৫ কিলোমিটার পথ যেতে এখন সময় লাগে ১৭ ঘণ্টা ২০ মিনিট। সমস্ত যাত্রীর জন্য উচ্চমানের শয্যা ব্যবস্থা আছে। এবং বিমান যাত্রীদের মতো এই রাজধানী এক্সপ্রেসে যাত্রীদের জন্য নানা ধরনের ম্যাগাজিন রাখা হয়। আছে সিসি টিভি ক্যামেরাও। এই ৫০ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার হরিদ্ররাও ও হাওড়ার ডিআরএম (D.R.M) ঈশাক খান রাজধানীর যাত্রীদের সব রকম নিরাপত্তা দেওয়ার কথা আশ্বস্ত করে বলেছেন- তারা যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা করবেন না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই রেল চালু করতে বাংলা প্রথমে ধাক্কা খেলেও তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে বিগত শতকের আটের দশকে বাঙালি রেলমন্ত্রী হবার জন্য। তিনি কোলকাতায় পাতাল রেল, চক্ররেল চালু করেছেন এবং প্রত্যেক জেলার সঙ্গে দ্রুতগামী রেল ব্যবস্থা চালু করে গেছেন যা আজও দ্রুত গতিরই আছে। তিনি কিভাবে কাজ করেছেন-সেটা একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই। আমার মনে আছে তিনি যখন রেলমন্ত্রী তখন একদিন তিনি বাংলায় লেখা একটি চিঠি পেলেন। সিপিএমের তত্কালীন দোর্দণ্ড ও প্রভাবশালী নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তের কাছ থেকে। চিঠিতে প্রমোদবাবু লিখেছিলেন —শ্রীমান বরকত তুমি তো অনেক রেল চালু করছো কিন্তু পুরুলিয়া-বাঁকুড়া যেতে সেই রাতে একটি মাত্র ট্রেন, আমাদের রাজনৈতিক কাজ-কর্ম করতে এই ২টি জেলায় খুবই অসুবিধা হয়। উত্তরে বরকত সাহেব লিখেছিলেন-ট্রেন আমি চালু করবো কিন্তু একটি শর্ত আছে। শর্তটি হলো ভোর ৬টায় বাঁকুড়া হয়ে পুরুলিয়ায় নতুন দ্রুতগামী এক্সপ্রেস চালু করবো ১০ দিনের মধ্যে। আর ভোর ৬টার ট্রেনটি হাওড়া থেকে বাঁকুড়া হয়ে পুরুলিয়া যাবে। প্রমোদবাবু উত্তরে বলেন, আমি হাঁপানির রোগী এই শীতের সময় ঠান্ডার মধ্যে হাওড়ায় যেতে পারবো না, তোমার বন্ধু জ্যোতিবসুকে পাঠিয়ে দেব।
জ্যোতিবসু তখন মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতিবাবু বরকত সাহেবকে ফোন করে জানালেন অতো ভোরে তিনি উঠতে পারবেন না। তাই তিনি জ্যোতিবসুর মন্ত্রিসভার প্রবীণ মন্ত্রী বিণয় চৌধুরীকে পাঠালেন। জ্যোতিবাবুর কথামতো ট্রেন উদ্বোধনের দিন জ্যোতিবাবু গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বরকত কোলকাতার বাড়িতে ফিরে এলে প্রমোদবাবু তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন—তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না, তুমি যে কাজ করলে তা আমার দলের মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে দ্রুত করাতে পারিনি। সেই ৩ বছর রেলমন্ত্রী থাকার সময় সংসদে প্রায় প্রতিদিনই সিপিএম সাংসদ প্রয়াত জ্যোতির্ময় বসু বরকত সাহেবকে কটূক্তি করে বক্তব্য রাখতেন। প্রমোদবাবু একদিন ফোন করে জ্যোতির্ময় বসুকে বলেন—বরকত সাহেব কাজের লোক এবং কাছের লোক। তাঁকে বার বার বিরক্ত কোরো না, এরকম করলে পরবর্তী নির্বাচনে তুমি মনোনয়ন পাবে না। প্রমোদবাবু থাকাকালীন জ্যোর্তিময় বসু আর মনোনয়ন পাননি।
বিগত ৫ বছরে এনডিএর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ট্রেন চালু করার কোনো ব্যবস্থা না হলেও নরেন্দ্র মোদি তাঁর নিজের রাজ্যের রাজধানী আহমদাবাদ ও বোম্বের মধ্যে জাপানের ধাঁচে বুলেট ট্রেন চালু করার কাজ শুরু করেছেন। কবে এই বুলেট ট্রেনের কাজ শেষ হবে তা বলা সম্ভব নয়, কারণ তিনি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং একাজ শেষ হয়তো হবে না। মোদির কার্যকাল ২৬শে মে শেষ হবে। বরকত সাহেবের আমলে রেলের শিলান্যান্স এবং উদ্বোধন একজনই করে গেছেন। যা ভারতের রেলের ইতিহাসে একটি অধ্যায়, তাঁর আগে বা পরে এরকম কাজ কেউ করেছেন বলে জানা নেই।
লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক
সুত্র:ইত্ফোক, ২০ মার্চ, ২০১৯