শিরোনাম

কুড়িগ্রাম টু ঢাকা

কুড়িগ্রাম টু ঢাকা

এক
ট্রেনের নাম রংপুর এক্সপ্রেস। রংপুর থেকে ঢাকা চলাচল করে সপ্তাহে ছয়দিন। রোববার বন্ধ। এই ট্রেনের সাথে কুড়িগ্রামের যাত্রীদের সংযোগ দিতে একটি শাটল ট্রেন চালু করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের আন্দোলন ছিল কুড়িগ্রাম-থেকে ঢাকা একটি সরাসরি আন্ত:নগর ট্রেন চালু করার। কিন্তু শাটল ট্রেনে মাত্র ৪০টি আসন সংরক্ষণ করে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর বন্দোবস্ত করেছেন সদাশয় সরকার।

রংপুর এক্সপ্রেস আমার আমার ঢাকার পথে রওয়না হবার কথা ছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। শুক্রবার সকালে সে যাত্রা শুরু হলো। মাত্র সাড়ে ১১ ঘন্টা লেট! তারপরেও রেল কর্তৃপক্ষের দয়ায় শেষ পর্যন্ত ট্রেনটি ছেড়েছে এটাই বা কম কীসে? খুব ভোরে ষ্ট্রেশনে এসে দেখলাম বেঞ্চের উপর শুয়ে অনেক যাত্রী ঘুমাচ্ছেন। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে ট্রেনের প্রতীক্ষা করে অবশেষে ক্লান্তির ঘুম কাবু করেছে তাদেরকে।
একজন মাঝবয়সী মানুষ। সম্ভবত চাকুরিজীবী হবেন। ঢুলুঢুলু চোখে বারবার ট্রেনের আগমনী পথের দিকে তাকিয়ে দেখছেন। তার চোখেমুখে ষ্পষ্টত: হতাশার ছাপ। সমবেত যাত্রীদের এতো কষ্টের মাঝে শান্তনা ছিল; শেষমেষ টিকিট নামক সোনার হরিণটি ধরতে পেরেছেন তারা। যারা পাননি সেই হতভাগাদের অবস্থা ভাবুনতো?

শাটল ট্রেনটি কাউনিয়া পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল ৭টা বেজে গেল। আমরা ট্রেন বদল করে বসে আছি। মিনিট বিশেক অপেক্ষার পর রংপুর কুড়িগ্রাম ট্রেনটি ছাড়ল গন্তব্যের দিকে। রাতের ট্রেনটি দিনে বেলায় যাত্রা করলো। ট্রেনের হইসেলের সাথে ষ্টেশনের কোলাহল ক্রমশ মিলিয়ে গেল। আমার সিটটি কামরার শেষের দিকে, দরজার পাশে। বসতে গিয়ে দেখলাম, প্লাষ্টিকের টুলে একজন নারী বসে আছেন। আপদমস্তক পর্দা, এমনকি হাতেও দস্তানা। চোখ ছাড়া কোন কিছু অনাবৃত নেই। কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়। অনুমান করলাম বয়সে তরুণি হবে।
-আপনি এখানে বসেছেন কেন?
-সিট পাই নাই তাই।
-টিকেটতো নেই।
-টিটি সাহেব বসতে দিয়েছেন।
বুঝলাম টিটি সাহেবের দয়ায় ইনি ভ্রমন করছেন। তবে দয়াবান টিটি নিশ্চয়ই মাগনা ভ্রমনের সুযোগ দিচ্ছেন না। কিছু টাকা যে হাতিয়ে নিয়েছেন, তা তরুণির কথায় ইংগিত পেলাম। নিজ দায়িত্বে একটি টুলেরও বন্দোবস্ত করেছে এই দস্তানাকন্যা। সে উঠেছে রংপুরে। যাবেন ঢাকায়। তা যাক। আমার একটু কষ্ট হবেতো, মেনে নেই আরকী! কিন্তু পরের ষ্টেশনে হুরমুর করে যাত্রী ওঠা শুরু করলো কামরায়। এসি কামরার বারোটা বাজলো মনে হয়। দরজা বন্ধ করা যাচ্ছেনা। ঠেলাঠেলিতে তরুণির আসনভঙ্গ হবার অবস্থা। আমার ঘারের উপর কয়েকজন হামলে পড়লো। কাঁধের ভাঙা হাড় মট করে আবার ভাঙে কিনা কে জানে? ৪-৫ জন পুলিশ সদস্যকে আসতে দেখে সাহায্যের আবেদন জানালাম। একজন কম বয়সী পুলিশ। দু’চারজনকে ঠেলে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালেন আমার পাশে।
ট্রেন ছেড়ে দিলো। এবার পুলিশ ভাইয়ের সাথে টুকটাক আলাপ করে সময় কাটাতে চাইলাম।
-ভাই আপনার বাড়ি?
-গাইবান্ধা জেলা।

-ভালো। তাহলেতো রংপুরেরই মানুষ। কিছু মনে করবেন না। আজকাল টাকা ছাড়াতো পুলিশে চাকুরি পাওয়া কঠিন। আপনার কত গেছে?
একটু দ্বিধায় পড়ে ক্ষাণিক চুপ থাকলো কনেষ্টেবলটি। ভাবলাম বেমক্কা প্রশ্ন করে বেচারাকে বিব্রত করলামনাতো? কিন্তু না। তরুণ পুলিশটি কিছু মনে করেননি। ছোট করে উত্তর দিলেন-৬ লাখ।
-কয় বছর হলো চাকুরিতে যোগ দিয়েছেন?
-৩ বছর।

-আপনার অনেক কম লেগেছে ভাই। কোটা ছিল নাকি? এখনতো শুনছি ১০-১২ লাখের নিচে কেউ চাকুরি বাগাতে পারছেনা। আর একটা প্রশ্ন করবো। কিছু মনে করবেন না। মানে আমার জানার কৌতুহল। এতো টাকা খরচা করে কেন চাকুরি নিলেন?
-আমার দুই ভাই চাকুরি করে। বাবা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। সুযোগ আসলো। একটা জমি বিক্রি করে আমার চাকুরির খরচ মেটালেন। বাবার হিসাব-জমিটার চেয়ে আমার একটা স্থায়ী জীবিকার ব্যবস্থাটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
কনষ্টেবলের কথায় বুঝলাম চাকুরির বাজারে কেন এতো টাকা উড়ছে। সবাই নিশ্চিত জীবন চায়। এক সময় কেউ পুলিশে যোগ দিতে চাইতো না। এখন প্রার্থী বাছাইয়ের দিন ঢল নামে শহরে। এরমধ্যে কত দালাল ঘোরাঘোরি করে। চিপাচাপায় গজ ফিতা নিয়ে কতজন বসে থাকে; চেস্ট আর হাইট মেপে দরদাম ঠিক করে-তার হদিশ কে করে?
দুই
দেখতে দেখতে গাইবান্ধা স্টেশনে ট্রেন এসে গেল। ঈদের ছুটি শেষে সবারই কর্মস্থলে যাবার তাড়া। বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে পরিবার শুদ্ধ অনেকেই ভিড় ঠেলে উঠতে চাচ্ছে। কারো টিকিট আছে, কারো নেই। এরমধ্যে একজন রাফ এন্ড টাফ যুবক ঢুকলেন ঝড়ের বেড়ে। মনে হচ্ছে ১৫০ কিলোমিটার বেগে টর্ণেডো বয়ে যাবে এবার। আমার পাশের সিটের একজন ভদ্রমহিলা তার ছেলে বসা। পেছনের কয়েকটি সিটের উপর রেলিং নেই। এই সিটগুলো সাধারণত কুড়িগ্রামবাসীর জন্য বরাদ্দ থাকে। কপালপোড়া মানুষদের এর চেয়ে আর বেশী কী দেয়া যায়! দু’একটি সিট ভাঙাও থাকে। সিটের উপরে ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা নেই। বড় ট্রাভেল ব্যাগ। তাই ভদ্রমহিলা সিট ঘেঁষে ব্যাগটি রেখেছেন। প্রথমেই রাফ এন্ড টাফ তোপ দাগলেন তার উপর। ‘ব্যাগ সরান। ব্যাগ কোলে নিতে পারেন না?’
পথে আরো ২-৩ জনকে কড়া ভাষায় ঝাড়ি দিলেন। কিছুদূর এগুনোর পর তার নির্দিষ্ট সিটের উপর অন্য কারো ব্যাগ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বকাঝকা শুরু করলেন। বললেন-‘মাথার উপর ব্যাগ রাখেন, জায়গা ফাঁকা রাখেন।’ সবাই এই রাফ এন্ড টাফের টর্ণেডো হামলা দেখছেন-কেউ কিছু বলছেন না।

তবে আমাকে বিষ্মিত করে গর্জে উঠলেন এক ভদ্র মহিলা। কামান দাগলেন ওই তরুণটির উপর।
-আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি। আপনি যথেষ্ট বেয়াদপি করছেন। গাইবান্ধার লোক কী করে এতো অভদ্র হয়। আমি নিজে গাইবান্ধার মেয়ে। আপনি কী সব বাজে কথা বলছেন।
-আমি আপনাকেতো কিছু বলিনি। তরুণটি তর্ক জুড়ে দেয়। তখনও বুঝতে পারেননি এই ভদ্রমহিলা কতো খতরনাক হতে পারেন।
-চুপ। বেয়াদোপ কোথাকার। আপনি কি পেয়েছেন? আপনার মতো গোঁয়ার আরে বাজে লোক কি করে ট্রেনে ওঠে। এটা ভদ্রলোকদের বগি।
এবার খামোশ হলেন রাফ এন্ড টাফ। স্ত্রী-সন্তানদের সামনে আর কতো অপদস্ত হবেন। বাকী পথটুকু তাকে শান্ত-সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে চলতে দেখলাম। আহা! নারীর ঝাড়ির এতো মাহাত্ব্য!
এই ভদ্রমহিলার সাথেই আমি আসলে ট্রেনে উঠেছি। তিনি কুড়িগ্রামের একটি কলেজের অধ্যক্ষের স্ত্রী। নিজে ঢাকার একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছেলে বুয়েটে পড়ে। ঘটনাক্রমে ওনাদের একটি বাড়তি টিকিটে আমি হতভাড়া ভাগ বসিয়ে যাত্রা শুরু করেছি।
আসলে টিকিটের কাহিনীটি আপনাদের বলা দরকার। কুড়িগ্রাম স্টেশনে সাটল ট্রেনের জন্য ৪০টি আসন বরাদ্দ থাকে। এরমধ্যে এসি সিট কর্তাব্যক্তিরা নাকি বুক করে রাখেন। বাকী টিকিটের জন্য প্রতিরাতে শ’তিনেক লোককে লাইনে দাঁড়াতে হতো। কিন্তু সবার ভাগ্যে মিলতোনা মহামূল্যবান টিকিট। সেহেরি খেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে এক যুবক দেখেন তার সিরিয়াল ১৪১ নম্বর। স্থানীয় সরকারি দলের কয়েকজন সুযোগসন্ধানী লাইনে দাঁড়ানোর চিহৃ হিসেবে ইট বসিয়ে টিকিট বাগিয়ে চড়াদামে পরে বেচেছেন-স্টেশন এলাকার এই দৃশ্য সবাই দেখেন। কিছু বলতে পারেননা।
এসব কাহিনী শুনে ভাবলাম টিকিট জোগার করা আমার পক্ষে একেবারেই দু:সাধ্য। শিক্ষক ও সমাজকর্মী কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম একখানা টিকিট জোগারের জন্য। স্টেশন সংলগ্ন তাঁর বাড়ি। কাদের অপারগতা প্রকাশ করে বললো-ভাই কামলা ছাড়া টিকিট জোগার করা যাবেনা।
-কামলা মানে?

-কামলা খুব ভোরে লাইনে দাঁড়াবে। টিকিট হাতে পেয়ে তাকে পেমেন্ট দিলেই হবে।
-যথা আচ্ছা। যা ভালো মনে করো। একটা ট্রেনের টিকিট জোগার করে দাও ভাই। বাসে যেতে কষ্ট হয়।
কাদের ২০০ টাকায় একজন কামলা জোগার করলো। কিন্তু কামলা লাইনে দাঁড়ানোর আগেই সামনে দীর্ঘ লাইন। রণেভঙ্গ দিয়ে কামলা ফিরে এলো। পরে ‘লোকাল পাওয়ার’ দেখিয়ে স্টেশন মাষ্টারকে অনেক হুমকি দিয়ে একখানা টিকিট জোগার করে দিয়েছেন কাদের। সুলভ চেয়ার। সবমিলে প্রায় ৮০০ টাকা খরচ। এই ট্রেনে যাবার কথা একটি কলেজের অধ্যক্ষ, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। ‘লোকাল পাওয়ার’ এ তিনি ৩টি এসি বগির টিকিট হাছিল করেছিলেন। হঠাৎ জ¦রে কাবু হওয়ায় তিনি যাত্রা বাতিল করলেন। আর মহামুল্যবান এসি টিকিটখানা আমার হস্তগত হলো। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! সেই সুত্রে ভাবি আর ভাতিজার সাথে ঢাকা যাত্রা শুরু হয়েছে।
তিন
বগুড়া স্টেশন। আবার হুড়োহুড়ি করে যাত্রী উঠছে। ছাদে, দুই বগির সংযোগ স্থলে, টয়লেটের সামনে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তারপরেও মানুষ উঠছে। দরজার সামনে মহা ভীড় লেগে গেল। সিটে বসে থাকা যেন দায় হয়ে গেল। দস্তানাকন্যার অবস্থা আরো করুণ। সে না পারছে বসতে, না পারছে উঠতে। তাকে বসিয়ে দেয়া টিটি মহোদয়ও কোন সাহায্য করতে পারছেনা। মাঝেমধ্যে তাকে দেখা গেলেও এদিকে তসরিফ আনছেন না। অবলা নারী বলে যতটা সম্ভব তাকে সেভ করছি ভীড় থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিল। এসি বগিতে অনেক যাত্রী তখনও দাঁড়িয়ে। এরমধ্যে আমার পাশেই ৫-৬ জন। একজন দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বসে পড়লেন বগির মেঝেতে। দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। যেন বলছেন, আমাকে বোকা ভাববেন না। দাঁত কেলানোটি দস্তানাকন্যার মুখোমুখি। আমি নিজেই স্বল্পভাষী, খেয়াল করলাম তাঁর চেয়ে বেশী দস্তানাকন্যা। আগ বাড়িয়ে কিছু জিঙ্গেস করছেননা। তারপরেও টুকটাক ছওয়াল-জবাব চলছে।
-আপনি কোথায় নামবেন?
-কমলাপুর
-কী করেন?
-গার্মেন্টেসে কাজ করি।
-কোন গার্মেন্টস।
তরুণি লা জবাব। এই তরুণি মিথ্যে বলছে নাতো। জেএমবির জঙ্গি নারী ক্যাডার কীনা কেন জানে? ছদ্মবেশ ধরেছে হয়তো। বেশী প্রশ্ন করে আবার বিপদে পড়বো নাতো? এ কথা ভেবে খামোশ হয়ে গেলাম।
ট্রেন চলছে। জানালা দিয়ে ফাঁকা মাঠ দেখছি। চলনবিল। দিগন্ত বিস্তৃত জমি। বর্ষায় টুইটুম্বর থাকে এই জলা জলাভূমি। তখন এর আলাদা সৌন্দর্য মুগ্ধ করে যাত্রীদের।
ট্রেন চলতে চলতে ভাবছি, কুড়িগ্রাম নিয়ে। ট্রেনের অতীত বর্তমান নিয়ে। এক সময় কয়লার ইঞ্জিন ছিল। বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়া। তারপরে ডিজেল ইঞ্জিন। অন্যান্য দেশে চলছে বিদ্যুৎ চালিত রেল। কতো কিছুই বদলে গেল। শুধু দেশের রেল তেমন বদলানো না।
ভাবছি, এক সময় কুড়িগ্রাম ছিল মঙ্গার জেলা। না খেয়ে মানুষ মারা যেত। বাসন্তি-দুগর্তির কাহিনী ঝড় তুলেছে দেশী-বিদেশী মিডিয়ায়। এখন অনাহারে কেউ মরে না। তবে মফিজ নাম বদলানো যাচ্ছেনা। এর কারণ অনুন্নয়ন-কাজের অভাব। গার্মেন্টস না থাকলে মৃত্যুর মিছিল কতটা থামতো বলা মুশকিল।
কুড়িগ্রামের মানুষের ভাগ্যবদল হচ্ছে ধীর গতিতে। এ জন্য মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাই বেশী মুখ্য। ঘাড় থেকে দুই দানব নামলেও ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে গেছে অনেক দূর। শহরের মাঝ দিয়ে চলা একটি লাইনতো উঠেই গেল। ট্রেনের সংখ্যা দুই থেকে এক এ নামলো। রমনা-থেকে কাউনিয়া একটি মাত্র লোকাল ট্রেন চলে। বিনা টিকিটের যাত্রীদের ভরসা। এক সময় এই ট্রেনের গতি নিয়ে নানা গল্প চালু ছিল। তার মধ্যে বুড়িমার গল্পটা হিট।

বুড়িমা লাঠিতে ভর দিয়ে পোটলা কাঁধে রেললাইন ধরে হাঁটছেন। তাকে দেখে ট্রেনের ড্রাইভারের মায়া হলো। ট্রেনের গতি থামিয়ে বুড়িমাকে ট্রেনে ওঠার আমন্ত্রণ জানালেন। বুড়িমা এই আহবান প্রত্যাক্ষাণ করে বললেন-‘না বাবা মোর খুব তাল আছে।’
দেশ স্বাধীনের অনেক বছর পরেও ট্রেনের একটু ভালো সেবা, সরাসরি ঢাকা যাবার স্বপ্ন এখনও অধরা কুড়িগ্রামবাসীর। দেশের অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকার সাথে সরাসরি ট্রেন থাকলেও কুড়িগ্রাম সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কতো এমপি মন্ত্রী এলো-গেল ট্রেন চালু হলোনা। অনেক আন্দোলনের পর সরাসরি ট্রেন নয়, শাটল ট্রেনটি দেয়া হলো শান্তনা স্বরুপ। শাটল ট্রেনে যে সামান্য টিকিট দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে মিটছেনা চাহিদা। বাধ্য হয়ে বাসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলছে হাজারো মানুষ। পথে কেউ কেউ মুখ থুবড়ে পড়ছে। গন্তব্যের বদলে মিলছে হাসপাতালের সফেদ শয্যা।

এসব ভাবতে ভাবতেই যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ ট্রেনে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেনও থেমে গেল। এসি বগি তখন আগুনের মতো জ¦লছে। ছোট শিশুদের নিয়ে বাবা-মায়েরা বড় বিপদে পড়ে গেলেন। কান্না-কাটিতে নরক গুলজারের মতো অবস্থা। হায় এসি-তোমার জন্য এতো আদিখ্যেতা!
বাইরে গলা বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করি কী হয়েছে। জানা গেল ছাদের উপর অতিরিক্ত যাত্রী ওঠায় এসি সিষ্টেম ফেল করেছে। তারপরেওতো লোক ছাদে উঠছে। এখন মাঝপথে এসে বিপদে পড়ে গেলাম। ট্রেনে পানি নেই। কেউ দৌড়াদৌড়ি করে পানি সংগ্রহ করছে। আমি তীব্র ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে দরজা পর্যন্ত গিয়ে একটি শশা জোগার করে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। ট্রেন থেকে নামলে আর ওঠার সুযোগ হবেনা। গেটে এক যুবতি ঝুলে আছে। ট্রেনে ঢোকার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি করছে। কেউ উঠতে দিচ্ছেনা। আধা ঘন্টারও বেশী এভাবে থাকার পর এসি চালু হলো। স্বস্তি নেমে এলো কামড়ায়। ট্রেন আবারও চলছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপারে স্টেশনে এসে ট্রেন থামার সাথে সাথে এক যুবক চিপায় থাকা মই এনে ট্রেনের ছাদের সাথে সংযোগ দিলেন। এরপর ২০-৫০ টাকা নিয়ে লোক তুলছেন ছাদে। সিষ্টেম মন্দ না। পুলিশ আর আনছার ভাইয়েরা দেখেও না দেখার ভান করছে। সব জায়গায় কমিশন সিষ্টেম।
একটু পর চেকার এসে সবার টিকিট চেক করছে। দস্তানা কন্যার কাছে টিকিট চাইলে সে ‘কবি নিরব’ টাইপের নিরব হয়ে রইল। কখনও কখনও নিরবতায় কাজ হয়। এখানেও তাই হলো। চেকার চলে গেল। আপাতত নিরাপদ রহস্যময় এই মেয়েটি।
আমি ট্রেনযাত্রার আদ্যপান্ত নিয়ে মোবাইল ফোনে স্ট্যাটাস লিখছি। দস্তানা কন্যা আড়চোখে দেখছেন। তা দেখুক, গোপন কিছুই তো লিখছিনা। একটু পর বললেন-
-‘আপনি ট্রেন নিয়ে কিছু লিখছেন মনে হয়। আসলে ট্রেনে খুব কষ্ট। আমি অনেক কষ্টে টিটিকে ম্যানেজ করে এখানে বসেছি। আপনার সহযোগিতা না পেলে হয়তো উঠতে হতো।
-না না। তেমন কিছু না। আপনি থাকেন। পুলিশ এসে কামরার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অনাহুত কয়েকজনকে বের করে দিলেন। পুলিশ কামরার ভেতর ঢোকার সাথে সাথে অনেকেই দ্রুত বাইরে যায়, পুলিশ চলে যাবার পর আবার আসে। অনেকটা চোর-পুলিশ খেলা।
পুলিশের হুইসেল শুনে কামরার গেটের বাইরে চলে গেলেন কেউ কেউ। এখন অল্প কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন আমার ঘাড়ের উপর। এদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে। দস্তানা কন্যাকেও তুলে দিতে চাইলে সে চোখের ইশারায় আমার সাহায্য চাইলো। অনেকটা করুণ চাহুনি। আমি কিছু বলতে যাবো। এ সময় পুলিশরা চলে গেল। হাজার হোক পুলিশেরতো দয়া মায়া আছে।
চার

ট্রেন অনেক লেট। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। এমন সময় সাদা ড্রেস পড়া ট্রে হাতে এক কেন্টিন বয় হাজির। হাসপাতালের নার্স আর ওয়ার্ড বয়দের মতো ড্রেস। তবে ময়লা। বললাম-‘কী খাবার আছে।’
-কাটলেট, বাটার, চিকেন। এক নি:শ^াসে বলে গেলেন।
-এই মেনুতো ২৫ বছর ধরে শুনছি। পরিবর্তন করা যায়না ভাই।
-কী করবেন ভাই-বৃটিশরা চালু করে গেছে।
-আহা বৃটিশ ভক্ত ভাই। দাঁড়ান আপনার একটা ছবি তুলে নেই। মোবাইল ক্যামেরার ফ্লাস জ¦লার সাথে সাথে কেমন যেন চুপসে গেলেন বৃটিশ ভক্ত। ভয় পেয়েছেন মনে হয়। কখন কী হয়। আরে ব্যাটা ভয় কেন পাও? তোমার সামনেইতো টিটিরা টাকা নিয়ে চিপায়-চাপায়, দরজা, গেট সবখানেই লোক বসিয়ে দিয়েছে। তাদের কি কোন দিন জেল ফাঁসি হবে? কখনও শাস্তি হয়েছে শুনছো? বছর শেষে ট্রেনের লোকসানটা কেন হয় বোঝনা?
ভাবছি, এরা বৃটিশের দোহাই দিয়ে অখাদ্য পঁচা-বাসি খাদ্য গছানোর তালে আছে। এদের কর্তারা ভারতের যে কোন ট্রেনে চাপলে বুঝতে পারতো সেখানে কেমন খাবার পাওয়া যায়। তারাও নিশ্চয়ই বৃটিশের উত্তরাধীকারী। বাংলাদেশের ট্রেনের যে কোন আধুনিকায়ন হয়নি, অথবা অজ্ঞাত কারণে ট্রেনকে অবহেলা করা হয়েছে-এটা বুঝতে খুব জ্ঞানি হবার দরকার নেই। সেই পুরাতন লক্কর ঝক্কর মার্কা ট্রেন, অনাধুনিক সিগনালিং, লাইন, ষ্টাফ, আসন ব্যবস্থা, স্টেশন, স্টেশনের মাস্টার, ওয়েটিং রুম, কোথাও তেমন পরিবর্তন নেই।
পাঁচ
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এখনও দুপুরের খাবারে অর্ডার নেয়া হচ্ছে। ডেলিভারি সন্ধ্যায়। যাক, তবুতো কিছু খাবার পাওয়া যাবে। ট্রেন কখন পৌঁছবে, তার নিশ্চয়তা নেই। বৃটিশ ভক্ত ভাইকে বলে খাবারের অর্ডার দিতে যাব-এসময় আমার পাওয়ারফুল ভাবি বাঁধা দিলেন। তিনিই তিন প্যাকেট খাবারের অর্ডার দিলেন। সবজি আর পাকিস্তানি মুরগী। এখন পাকিস্তানি মুরগীর রমরমা বাজার। খেতে অনীহা থাকলেও ক্ষুধা কিছুই মানছেনা।

ট্রেন চলছে। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর সাদা বয়টি সাদা প্যাকেটে করে খাবার দিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো পানি নেই। এখন উপায়। দস্তানা কন্যা হাত বাড়িয়ে দিলেন। না হাত না। পানির বোতল। খাবার অফার দিলে সে না করলো। গোগ্রাসে পাকিস্তানি মুরগী দিয়ে ভোজন সেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। একাত্তরে দুই একটারে পাইলে এভাবে রসিয়ে ভোজন করা যেত। দুর্ভাগ্য তখন যুদ্ধে যাবার বয়স হয়নি।
আমার গন্তব্য বিমানবন্দর স্টেশন। ভাবি ও তাঁর ছেলেসহ আমি নেমে যাচ্ছি। সামনে কমলাপুর স্টেশন। বাকী পথটুকু সিটে বসতে পেয়ে খুশি হবার কথা দস্তানা কন্যার। কিন্তু না। আগের মতোই তাঁর মলিন মুখ। কথা নেই। তার কাছে বিদায় নিয়ে নামলাম প্লাটফর্মে। রাতেই ফেসবুকে দেখলাম ওইরকম দস্তানা পরিহিত এক তরুণির ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট। কলেজ ষ্টুডেন্ট। রহস্য আরো ঘনিভূত হলো। জঙ্গি সন্দেহটা আরো প্রকট হলো। ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট একসেপ্ট না করে দ্রুত ডিলিট করে দিলাম।

লেখক:আব্দুল খালেক ফারুক,
সাংবাদিক ও লেখক


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.