ইসমাইল আলী: সারা দেশে বিদ্যমান রেলপথের ওপর সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় দেশের দুই শীর্ষ শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকো ও সিকদার। দেশীয় গ্রুপ দুটির অভিজ্ঞতা না থাকায় এক্ষেত্রে যুক্ত করা হয়েছে কানাডাভিত্তিক স্কাইপাওয়ার গ্লোবালকে। এতে দেশজুড়ে ৭০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে জানানো হয়েছে প্রাথমিক প্রস্তাবে, যদিও কারিগরিভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, রেলপথের ওপর সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৪৪ পয়সা (দশমিক ১৬ সেন্ট)। এর মধ্যে রেলপথ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে ইউনিটপ্রতি দেওয়া হবে ৪২ পয়সা (আধা সেন্ট)।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে দুই দশমিক ৭০ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক (রেলপথ) দরকার হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান রেলপথের দু’পাশে পিলার দিয়ে তার ওপর কাঠামো নির্মাণ করা হবে। সে কাঠামোর ওপর সোলার প্যানেল বসানো হবে। এক্ষেত্রে প্রচলিত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে নির্মাণ ব্যয় সাত থেকে ১০ শতাংশ বেশি হবে। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি কোনো জমি প্রয়োজন হবে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বর্তমানে দেশে চলমান বিভিন্ন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকছে।
প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা থেকে সিলেট, ঢাকা থেকে রাজশাহী ও ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত বিদ্যমান এক হাজার ৫৪৫ কিলোমিটার রেলপথ ব্যবহার করা হবে। এক্ষেত্রে ৫৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রেলপথের ওপর সোলার প্যানেল বসানো হবে। এতে অবশিষ্ট ৩৬২ কিলোমিটার রেলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। সব মিলিয়ে সারা দেশের এক হাজার ৯০৭ কিলোমিটার রেলপথের ওপর ৭০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
বেক্সিমকো গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপের পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস এবং স্কাইপাওয়ার গ্লোবাল যৌথভাবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এক্ষেত্রে বিশেষায়িত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে স্কাইপাওয়ার। আর এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি ১০০ কিলোমিটারে দুই হাজার ৩০০ জনের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে। এতে প্রাথমিক চার রুটে (ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রাজশাহী ও ঢাকা-খুলনা) ৩৫ হাজার জনের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, প্রতি ১০০ কিলোমিটারে মাত্র ৭৫ হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হবে। ফলে প্রকল্পটি পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। বিদ্যমান রেলপথের ওপর স্থাপিত সোলার প্যানেলের ফলে ট্রেনের বগিগুলো অতিরিক্ত গরম থেকে রক্ষা পাবে। আবার ট্রেনের ছাদে বিনা টিকিটে যাত্রীদের ভ্রমণ বন্ধ হবে। এছাড়া স্থাপিত অবকাঠামোর সাহায্যে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা দেওয়া হবে। ফলে ট্রেনের যাত্রীরা বিনা খরচে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাড়তি সুবিধা পাবে।
এদিকে বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার জন্য উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ প্রয়োজনে রেলওয়ে নিজেই কিনতে পারে। এতে রেলের ডিজেল ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণ কমবে। আর রেলওয়ে এ বিদ্যুৎ না কিনলে রেলপথের আশপাশের জনগণের কাছে এ বিদ্যুৎ বিক্রি করা যাবে।
সূত্র জানায়, গত বুধবার এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তাব জমা দিলেও তা কারিগরিভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বৈঠকে জানানো হয়। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, রেলপথের দুই পাশে পিলার নির্মাণ ও তার ওপর সোলার প্যানেল বসানো হলে ট্রেন পরিচালনায় দুই ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। প্রথমত, ডাবল ডেকার (দোতলা) যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন চালুর অন্তরায় হবে এ প্রকল্প। কারণ আগামীতে ডাবল ডেকার ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে রেলের। দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। কারণ উদ্ধারকারী ট্রেনের ক্রেন ৩৬ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু হয়ে থাকে।
এর বাইরে আরেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে এ প্রকল্পে। সেটি হলো ট্রেন দুর্ঘটনায় বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের কাঠামোর ওপর পড়লে তা ভেঙে সোলার প্যানেলের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার বহন করবে কারাÑএটিও প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুতেও এ কাঠামো প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, রেলপথের দু’পাশে পিলার নির্মাণ ও তার ওপর সোলার প্যানেল বসানোর বেশকিছু ঝুঁকি রয়েছে। তাই ওই প্রস্তাব খতিয়ে দেখতে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্তারিত প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে। কারিগরি কমিটির মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সুত্র:শেয়ার বিজ, নভেম্বর ৩, ২০১৮