ইসমাইল আলী: দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার সঙ্গে খুলনার রেল সংযোগ স্থাপন প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর পরামর্শক নিয়োগ ও নকশা প্রণয়নেই পেরিয়ে যায় প্রায় পাঁচ বছর। ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ হলেও এবার ত্রুটি ধরা পড়েছে প্রকল্পটির অধীন রূপসা রেল সেতুর নকশায়। লোড টেস্টে দুই দফা ফেল করেছে সেতুটির পরীক্ষামূলক পাইল। ফলে এখন নকশা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি রেল ভবনে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. মজিবর রহমান। এতে প্রকল্পটির সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে প্যানেল অব এক্সপার্ট গঠনের সুপারিশ করা হয়। যদিও নকশা সংশোধনের জন্য প্রস্তাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির।
এদিকে নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু জনবল চলে গেছে। তাদের প্রতিস্থাপন নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। আবার চুক্তির বাইরে প্রকল্পটির পরামর্শকের পাওনাও নিয়মিত পরিশোধ করছে না রেলওয়ে। এজন্য প্রকল্প পরিচালককে চুক্তি বাতিলের নোটিস দিয়েছে কোম্পানিটি। বর্তমানে রূপসা রেল সেতু নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। আর এ সেতু ছাড়া খুলনা-মোংলা রেলপথ চালু সম্ভব নয়।
রেল ভবনে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, রূপসা রেল সেতুর খুলনা প্রান্তের ভায়াডাক্ট অংশে একটি ৪০ মিটার গভীর ও দেড় মিটার প্রস্থ ডায়া টেস্ট পাইল করা হয়। গত ১০ জানুয়ারি এর লোড টেস্ট করা হলে ফল সন্তোষজনক হয়নি। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পুনরায় একই স্থানে ৪০ মিটারের পরিবর্তে ৫২ মিটার দৈর্ঘ্যরে আরেকটি পাইলের নকশা জমা দেয়। এক্ষেত্রে একটি বেইজ গ্রাউটিংসহ ও আরেকটি বেইজ গ্রাউটিং ছাড়া লোড করতে বলা হয়।
টেস্ট পাইলের নকশাটি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেশাদার প্রকৌশলী দ্বারা পরীক্ষা করে প্রত্যয়ন গ্রহণের সুপারিশ করে রেলওয়ে। তবে বুয়েটের প্রত্যয়ন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত দেখিয়ে বলা হয়, কোনো নকশা দাখিলের আগেই পেশাগত প্রকৌশলীর প্রত্যয়ন গ্রহণ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বেইজ গ্রাউটিং ছাড়া ৫২ মিটার দৈর্ঘ্যরে দেড় মিটার ডায়া টেস্ট পাইল করে ৩০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত লোড টেস্ট করা হয়। তবে দুটি পাইলই লোড নিতে ব্যর্থ হয়। এতে নির্মাণকাজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন পিয়ার পয়েন্টে মাটির অবস্থা খুবই খারাপ। এটি এতটাই খারাপ যে, ডিজাইন লোড বহন করা খুবই কঠিন। এজন্য প্রতিটি পিয়ার লোকেশনে পাইল পুনরায় ডিজাইন করতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বেইজ গ্রাউটিং করে পাইলের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মৌখিকভাবে জানায়, বেইজ গ্রাউটিংয়ের বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন পুনঃপরীক্ষা করা দরকার, যাতে টেকসই সেতু নির্মাণ করা যায়। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ দ্বারা একটি প্যানেল এক্সপার্ট গঠন করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে সেতু নির্মাণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ এ দেশের নদীগুলো প্রচুর পলি বয়ে আনে। এগুলো জমা হয়ে মাটির ওপর একটি স্তর তৈরি হয়। তবে এর নিচে মাটির অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। এজন্য টেস্ট পাইল ফেল হতে পারে। দেশের অনেক বড় সেতুতে এ ধরনের ফেইলুর হয়েছে। রূপসা সড়ক সেতু, বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুসহ অনেক সেতু নির্মাণে এ সমস্যা হয়েছিল। পরে পাইলের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রূপসা রেল সেতুতেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। পরীক্ষামূলক পাইল লোড নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে দেবে যাওয়ার একটা গ্রহণযোগ্য পরিমাণ রয়েছে; রূপসায় সেটি হয়নি। তবে সেটা সমাধান করা যাবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নতুন নকশা জমা দিয়েছে। সেটি গ্রহণযোগ্য কি না, তা বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখবেন। এরপর টেস্ট পাইল করে লোড পরীক্ষা করা হবে।
যদিও অদক্ষ প্রতিষ্ঠানের নকশায় এত বড় রেল সেতু নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, রেলের একটি ইঞ্জিনের ওজন ১১০ টন। তবে এটি যখন ৬০-৮০ কিলোমিটার গতিতে চলে, তখন তা দুই থেকে আড়াইগুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এজন্য লোড টেস্টে কমপক্ষে তিনগুণ ওজন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এজন্য বেইজ গ্রাউটিং জরুরি। না হলে দক্ষিণাঞ্চলে এত বড় সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, খুলনা-মোংলা রেলপথের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে ভারতের কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স গ্রুপ ও নিপ্পন কোয়িই ইন্ডিয়া লিমিটেড। ২০১২ সালে সেতুসহ রেলপথটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে প্রতিষ্ঠানদ্বয়। পরের বছর এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। আর ২০১৪ সালে এর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়।
তবে সে বছরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৪ পরামর্শক প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে। এর মধ্যে চারজন আন্তর্জাতিক ও ১০ জন ভারতীয় পরামর্শক ছিলেন। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) যাচাই-বাছাই শেষে একজন আন্তর্জাতিক (টিমলিডার) ও দুজন ভারতীয় পরামর্শক প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর মধ্যে চলতি বছরের ৭ মার্চ টিমলিডার ও ডেপুটি টিমলিডার কাজে যোগ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় তিনজন আন্তর্জাতিক ও ১০ জন ভারতীয় পরামর্শক প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে রেলপথ ও সেতু নির্মাণ চুক্তি শেষ হবে ২০২০ সালে। এজন্য পরামর্শকের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো দরকার। এছাড়া সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নে বেশি সময় লাগায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি বেশি অর্থ দাবি করে। এজন্য গত ৪ এপ্রিল একটি চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ পরিশোধে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। তা না হলে চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রসঙ্গে মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভেরিয়েশন প্রস্তাব নিয়ে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে ভেরিয়েশন প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আছে। দ্রুতই এ সমস্যাটির সমাধান করা যাবে। আর সেতুটি নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে নির্মাণকাজ কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও একবার শুরু হলে তা দ্রুত এগিয়ে নেওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, রূপসা রেল সেতু নির্মাণ করছে ভারতের লারসন অ্যান্ড টার্বো লিমিটেড। পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার এ সেতুর মূল অংশ ৭১৬ দশমিক ৮০ মিটার। আর চার দশমিক ৪১৩ কিলোমিটার ভায়োডাক্ট। পুরো সেতুটি স্টিল কম্পোজিট গ্রিডে তৈরি হবে। ২০১৫ সালে এজন্য চুক্তি সই হয়। সেতুটি নির্মাণের চুক্তিমূল্য ছিল এক হাজার ৭৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
সুত্র:শেয়ার বিজ, ২১ মে ২০১৭