ইসমাইল আলী: ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া রেলপথ। তবে ১৯৯৭ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও ২০১১ সালে ওই অংশটি পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। এর সঙ্গে যোগ করা হয় কাশিয়ানী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ। ২০১৩ সালে কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া অংশটি উদ্বোধন করা হয়। তবে ওই অংশের নির্মাণকাজ নিম্নমানের ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হচ্ছে। যদিও এ ব্যয়ের একাংশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
সম্প্রতি প্রকল্পটির দ্বিতীয় দফা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। এতে বলা হয়, ১৯৯৭ সালে বন্ধকৃত কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া সেকশনটি আবার চালুকরণ এবং টুঙ্গিপাড়া উপজেলাকে বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কাশিয়ানী থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১০ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ১০১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন শেষ করার কথা ছিল।
পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি করে দুই হাজার ২৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা করা হয়। এতে ব্যয় বাড়ে ৯২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা প্রায় ৮৪ শতাংশ। সে সময় বাস্তবায়ন মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়। তবে বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও প্রকল্পের কাজ এখনও অনেক বাকি রয়ে গেছে। এখন আবার প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অংশের ব্যয় ১৮৫ কোটি ১২ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াচ্ছে দুই হাজার ২০৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, প্রকল্পটির জন্য ৬৭ দশমিক ৯০ একর জমি অধিগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে। তাই এ খাতে ব্যয় ২৪ কোটি ৫২ লাখ কম হয়েছে। কাশিয়ানী-টুঙ্গিপাড়া সেকশন লাইনের পরিমাণ ছয় দশমিক ৭২ কিলোমিটার হ্রাস পেয়েছে। তবে নির্মাণকাজ তত্ত¡াবধান বাবদ এক কোটি ৪১ লাখ টাকা ও আসবাব কেনায় তিন কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া মাটির কাজ ৮০ কোটি টাকার অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে প্রকল্পটির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বিধায় কনটিনজেন্সি খাতে ১০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে না মর্মে সভায় ব্যক্ত করা হয়। এর মধ্যে প্রাইস কনটিনজেন্সি রয়েছে ৪২ কোটি সাত লাখ ও ফিজিক্যাল কনটিনজেন্সি ৬৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ অর্থ বাদ দিয়ে প্রকল্প পুনর্গঠনের প্রস্তাব করে পিইসি। এছাড়া যেসব খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও হ্রাস পাচ্ছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) যুক্ত করতে বলা হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের মধ্যে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতেও আপত্তি তুলেছে পিইসি। এক্ষেত্রে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড বাদ দিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ হিসাব করার শর্ত দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। তবে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড বাদ দিলে বাস্তব অগ্রগতি ৮০ শতাংশের কাছাকাছি হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির একটি অংশের কাজ শেষ হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালেই উদ্বোধন করেন। এখন কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ অংশের কাজ শেষ হওয়ার পথে। এক্ষেত্রে দরপত্র অনুযায়ী ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাব করা হয়েছে। পিইসি সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ডিপিপি সংশোধন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) পাঠানো হবে।
এদিকে ২০১৩ সালে কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া অংশটি উদ্বোধন করা হলেও এর নির্মাণকাজের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত আগস্টে অতি বর্ষণের সময় এ এলাকায় রেলপথ দেবে যায়। এতে ট্রেন চলাচল এক সপ্তাহের বেশি সময় বন্ধ ছিল। পরে রুটটিতে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। যদিও রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা তা অস্বীকার করছেন।
তাদের মতে, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া রেলপথটি পুনর্নির্মিত হলেও এর এমব্যাংকমেন্ট (বাঁধ) নির্মিত হয়েছে প্রায় ১০০ বছর আগে। রেলপথ পুনর্র্নির্মাণে ভূমি উন্নয়ন বাবদ কোনো বরাদ্দ ছিল না। এ কারণে সয়েল ট্রিটমেন্টের কাজ করা হয়নি। পুরোনো এমব্যাংকের ওপর নতুন রেললাইন বসানো হয়েছে। রেলপথে যেসব অংশ দেবে গেছে যেখানে মাটি খুবই দুর্বল। ট্রেন চলাচলের কারণে কোথাও এমব্যাংকমেন্টের নিচের ‘অর্গানিক সয়েল’ বেরিয়ে এসেছে। এবারের বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে, রেলপথ নির্মাণের আগে মাটি ভরাটে করে শক্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তার ওপর বসানো হয় লোহার পাত তথা রেললাইন। যদি মাটির কাজ না করেই রেল বসানো হয় তাহলে অবশ্যই কাজের মধ্যে ত্রুটি ছিল।
রেলের অপর এক কর্মকর্তা জানান, ফরিদপুরের মধুখালী থেকে সাতৈর পথে ৫৮ নম্বর রেল সেতুর কাছে এমব্যাংকমেন্ট প্রায় দুই ফুট দেবে গেছে। মূলত ‘ব্লাক কটন সয়েল’-এর কারণে এ অবস্থা হয়েছে। পুনর্র্নির্মাণকালে আগের লাইনের ওপর রেল বসানো হয়েছে। এই ব্লাক কটন সয়েল পাওয়া যায় রেলপথের ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীরে। এটি অনেকটা চোরাবালির মতো। কালুখালী থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথের চারটি অংশে ১০০ থেকে ২০০ মিটার এমব্যাংকমেন্ট দেবে গেছে।
এদিকে রেলের নথিতে দেখা গেছে, এ রেলপথের জন্য বিভিন্ন স্পটে ২৫০ মিটার পর পর সয়েল টেস্ট করে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। সেখানে কমপ্রিহেনসিভ ফিল্ড অ্যান্ড ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন করে পিভিডি ইনস্টলেশন (প্রি-ফেবরিকেটেড ভার্টিক্যাল ড্রেইন) বিষয়ে কিছু মতামত দেওয়া ছিল। সেগুলো হচ্ছে‘প্রকল্প এলাকার ভ‚মি আদিকাল থেকে নিচু ও বছরের বেশিরভাগ সময়ে জলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। শুষ্ক মৌসুমে শস্য উৎপাদনের ক্ষেত হিসেবে ব্যবহƒত হয়েছে। এর ভ‚গর্ভস্থ অংশে সফট সয়েল অ্যান্ড ব্লাক কটন সয়েলের স্তর গঠন করেছে। এই সফট সয়েল/ব্লাক কটন সয়েল স্তর এমব্যাংকমেন্টের নিজস্ব ভার বহনেই সক্ষম নয়। এ স্তর বিদ্যমান থাকলে ভবিষ্যতে নির্মিতব্য ব্রডগেজ ট্র্যাক তথা এমব্যাংকমেন্ট ডিজাইন লোড (২৫ টন এক্সেল লোড) বহনে সক্ষম হবে না। নিরাপদ ট্রেন পরিচালনার জন্য এমব্যাংকমেন্ট তথা ট্রাকের স্ট্যাবিলিটি অর্জন আবশ্যক। তাই পিভিডি ইনস্টলেশন জরুরি।’
জানতে চাইলে রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমরাও জেনেছি। এমনটি ঘটতেই পারে। এটি পুরোনো রেলপথ। তাই নতুন করে পুনর্বাসন করা হয়েছে।’