শিরোনাম

বিনা টিকিটের স্টেশন

বিনা টিকিটের স্টেশন

মুজিবুর রহমান দুলাল: স্টেশন আছে। ট্রেন থামে। যাত্রীও ওঠে। তবে টিকিট কাটে না কেউ। কাটবেই বা কী করে? এ স্টেশনে রেলওয়ের কোনো কর্মীই নেই। বিনা টিকিটের এ স্টেশনের দেখা মিলেছে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার দৌলতগঞ্জে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে এমন ছয়টি বিনা টিকিটের স্টেশন রয়েছে।

এ স্টেশনগুলো হচ্ছে দৌলতগঞ্জ, খিলা, বিপুলাসার, বজরা, মাইজদি ও হরিনারায়ণপুর। প্রতিদিন এ স্টেশনগুলোতে আটটি ট্রেন থামে। গড়ে ১০০ যাত্রী ওঠানামা করে। কেউই টিকিট কাটে না।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, জনবলের চরম সংকটের কারণে স্টেশনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এদিকে স্টেশনগুলো বন্ধ থাকায় রাতে সেখানে মাদকসেবীদের জমজমাট আড্ডা বসে। চলে অসামাজিক কার্যক্রমও।

গতকাল বৃহস্পতিবার লাকসাম উপজেলার প্রাচীনতম দৌলতগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের ভিড়। একসময় ট্রেন এলো। যাত্রীরা উঠল। কেউ কোনো টিকিট কাটে না। এখানে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা ভাড়া নেওয়ার কথা।

যাত্রীরা জানায়, টিকিট বেচা ও মালামাল পরিবহনে বুকিং কার্যক্রম বন্ধ। এ কারণে যাত্রীরা বিনা টিকিটে ভ্রমণ এবং বুকিং ছাড়াই মালামাল পরিবহন করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশন মাস্টারের কক্ষে তালা ঝুলছে। আশপাশে কোনো কর্মচারী নেই। এ স্টেশনের অনেক পুরনো কর্মচারী (পোর্টার) মো. সেলিম মিয়া। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটি বেঞ্চে বসে আছেন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ স্টেশনে চাকরি করেন। ২০১৭ সালে তিনি অবসর নেন। বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই প্রতিদিন স্টেশনে এসে বসে থাকেন। পুরনো লোকজনের দেখা পেলে গল্প করে সময় কাটান।

সেলিম মিয়া জানান, ২০০৮ সালের ৫ জুলাই এখানকার স্টেশন মাস্টার বদলি হন। ফলে এ স্টেশনে টিকিট বেচাসহ বুকিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এ রুটে ডেমু ট্রেন চালু হওয়ায় শুধু ওই ট্রেনেরই টিকিট বেচা হতো।

লাকসাম রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার (এসএম) মো. কামরুল হাসান তালুকদার জানান, লাকসাম থেকে নোয়াখালীর দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। ওই রেলপথে মোট ১২টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে অনেক বছর ধরে ছয়টি স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন ওই রুটে দুটি আন্ত নগর, দুটি এক্সপ্রেস, দুটি লোকাল, চারটি ডেমুসহ ১০টি ট্রেন চলাচল করে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৮৯১ সালে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়। ১৮৯৫ সালে উদ্বোধন করা হয় লাকসাম রেলওয়ে জংশন (তৎকালীন বড়তুপা)। পর্যায়ক্রমে লাকসাম থেকে নোয়াখালী ও চাঁদপুরে দুটি রেললাইন সম্প্রসারিত হয়। লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথ প্রতিষ্ঠার সময় দৌলতগঞ্জ স্টেশনটি স্থাপন করা হয়। এ স্টেশনটি ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় নদীপথে আসা মালামাল ট্রেনে আনা-নেওয়ার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হতো। ওই সময় তিনজন স্টেশন মাস্টার (এসএম), তিনজন সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএসএম), গুডস ক্লার্ক, বুকিং ক্লার্ক, টালি ক্লার্ক পদে একজন করে এবং নিরাপত্তা বাহিনী পদে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সব গুরুত্বপূর্ণ সব পদই এখন শূন্য। পোর্টার পদে দুজনের মধ্যে একজনও নেই। এ ছাড়া পয়েন্টসম্যান পদে পাঁচজন কর্মচারী। সব পদই শূন্য। ফলে লোকবলের সংকটে স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্য পাঁচটি স্টেশনেরও একই অবস্থা।

লাকসাম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তাবারক উল্লাহ কায়েস জানান, দৌলতগঞ্জ অত্যন্ত প্রাচীন এবং একটি বিশাল বাণিজ্যিক শহর। এখানে বিভিন্ন কল-কারখানাসহ ছোট-বড় প্রায় তিন হাজার ৮০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘স্টেশন মাস্টার, বুকিং সহকারী এবং পয়েন্টসম্যানের অত্যন্ত সংকট রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) সঙ্গে কথা বলুন। তিনি ভালো বলতে পারবেন।’

রেলওয়ে চট্টগ্রামের ডিসিও মো. আনসার আলী মুঠোফোনে বলেন, ‘স্টেশনগুলো বন্ধ রয়েছে—এ খবর আমার জানা নেই। আপনার ফোনের মাধ্যমেই এখন জানতে পারলাম। স্টেশনগুলো বন্ধ তো আমি কী করব?’ এভাবেই একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাঁর দায় এড়ালেন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আইনি জটিলতার কারণে অনেক নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। এ কারণে স্টেশনগুলোর কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে লোকবল সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা নিরসনে শিগগিরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সুত্র:কালের কন্ঠ, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ 


About the Author

RailNewsBD
রেল নিউজ বিডি (Rail News BD) বাংলাদেশের রেলের উপর একটি তথ্য ও সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল।

Comments are closed.