দুই মাস ধরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জরুরি নির্দেশনা সত্ত্বেও বাণিজ্য শুরু করা যায়নি। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বেনাপোল কাস্টম হাউস ও বন্দর সার্বক্ষণিকভাবে চালু রয়েছে। ভারতের বনগাঁর পার্কিং সিন্ডিকেট বাণিজ্য চালু করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষতি পোষাতে কাস্টমস কমিশনার অবাধে সাইডডোর ও এফসিএলসহ সব ধরনের রেলকার্গো বেনাপোল দিয়ে চলাচল ও পণ্য খালাসের অনুমতি চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জরুরি চিঠি দিয়েছে। এর আগে কাস্টমস, স্থলবন্দর ও ব্যবসাবান্ধব রেলকার্গো চালুর জন্যে ত্রিপক্ষীয় সুপারিশ করা হয়েছে।
বেনাপোল বন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য, কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আমদানিকারকরা চীন ও ইউরোপের পরিবর্তে ভারত থেকে পণ্য ও কাঁচামাল আনতে আগ্রহী। তবে বিলম্ব ও হয়রানির কারণে তারা বেনাপোল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান শিল্প ও বাণিজ্যিক পণ্যের প্রয়োজন থাকায় ভারতীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে বেনাপোলে রেলকার্গো চালু করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সূত্র আরও জানায়, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ রেলকার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ট্রাকে বাহিত পণ্য বেনাপোল আসতে যেখানে পাঁচ থেকে সাত দিন লাগে, সেখানে রেলকার্গোতে পৌঁছাতে লাগে মাত্র তিন ঘণ্টা। বাকি কয়েক ঘণ্টায় শুল্কায়ন ও খালাস কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
সূত্রমতে, গত ১৯ মে চালবীজের ৭৭৫ মেট্রিক টনের চালান দুই ঘণ্টায় শুল্কায়ন করা হয়। ১২ ঘণ্টারও কম সময়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ট্রেন গন্তব্যে চলে যায়। এক পণ্যের ভাড়াও ট্রাকের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ট্রাকে ভাড়া বেশি। পার্কিং সিন্ডিকেটের ট্রাক আটক রাখা, ড্রাইভার সংকট ও কভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য খরচ বাড়ে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। এ পরিস্থিতিতে পুরোদমে রেলকার্গো চালু হলে আমদানি দ্বিগুণ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বনগাঁর পার্কিং সিন্ডিকেটের প্রভাবে বেনাপোলে রেলকার্গো আগমনের সিদ্ধান্তও বিলম্বিত হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে গত দু’মাস বেনাপোলে ট্রাক ঢুকছে না। গত ৩০ এপ্রিল দিল্লির নির্দেশে বাণিজ্য চালু হলেও আবার বন্ধ হয়ে গেছে। বনগাঁর নেতাদের চাঁদার টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বই এ অচলাবস্থার মূল কারণ বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, সর্বশেষ বাংলাদেশে রপ্তানি করা ১৫টি ট্রাক খালাস করার বিনিময়ে আদায় করা টাকার ভাগ তৃণমূলের ও সিন্ডিকেটের সব নেতা পাননি বলে পরের অচলাবস্থা তৈরি করা হয়েছে। অচলাবস্থা ধরে রাখতে সিন্ডিকেট বেনাপোলে শত শত করোনা রোগী মারা যাওয়ার ভুয়া গুজব বনগাঁয় রটিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
সূত্রমতে, পার্কিং সিন্ডিকেটের তৈরি সংকটজনিত অচলাবস্থায় সীমান্তে আটকে পড়ে পাঁচ হাজার ট্রাক। কালীতলাসহ এসব পার্কিংয়ে অপেক্ষমাণ পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে অক্সিজেন, ওষুধের কাঁচামাল, পাট, ধান, ভুট্টাবীজ, শিশুখাদ্য, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা, ফলমুল ও শিল্পের কাঁচামাল। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও পচনশীল পণ্য। বেনাপোলের একাধিক সূত্র বলেছে, দিল্লি-ঢাকা যৌথভাবে নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য সতর্কতা বজায় রেখে বাণিজ্য চলবে। প্রতিদিন বেনাপোল কাস্টমস ও স্থলবন্দর থেকে পেট্রাপোলে যোগাযোগ করা হয়েছে। দফায় দফায় সভা হয়েছে। সেই ২৩ মার্চ থেকে ট্রাকে বোঝাই জরুরি পচনশীল পণ্য আনার জন্য বারবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ট্রাকে অপেক্ষমাণ বিভিন্ন প্রকার বীজ নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে বীজতলার মৌসুম চলে যাচ্ছে। ‘দেব, দিচ্ছি’ করে বনগাঁর নেতারা পণ্য দেননি। উভয় সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি।
সূত্র আরও জানায়, ভারতীয় পণ্য ট্রাকে উঠলেই বাংলাদেশি আমদানিকারককে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এলসিতে প্রাপকের মূল্য পরিশোধের শর্তেই এটা বলা থাকে। আমদানিকারকদের অন্য দেশের আমদানি পণ্য সমুদ্রপথে সময়মতো চলে আসছে। অথচ দুই মাসেও আসেনি ভারতীয় পণ্য। ফলে লোকসানের সঙ্গে বাজারে কৃত্রিম সংকটের আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের পরিণামদর্শিতায় সেটা হয়নি।
ভুক্তভোগীর জানান, বনগাঁতে সব প্রতিবাদের পরিণতি ট্রাক বন্ধে। বলা নেই কওয়া নেই, একজন নেতা বললেন, বাংলাদেশে ট্রাক ঢুকবে না। আর বন্ধ হয়ে গেল! বিনা নোটিসে কৃত্রিম সংকটে ট্রাক বন্ধের যত অজুহাত। কর্মচারী ও ড্রাইভারের ঝগড়া, দুই সংগঠনের বিরোধ, শ্রমিক-কর্মচারী-ড্রাইভার ধর্মঘট, নতুন টিমের যোগদানÑযা-ই নতুন ঘটুক এসব তুচ্ছ কারণে ট্রাক ঢোকা বন্ধ করা হয়! এ অবস্থায় আর্থিক ক্ষতি গুনছেন বাংলাদেশের নির্দোষ আমাদানিকারক ও ভোক্তারা।
এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বনগাঁ উত্তরের সাবেক এমএলএ গোপাল শেঠ ও বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শংকর আঢ্য ডাকু পণ্য রপ্তানিতে বিরোধিতা করে কালীতলা পার্কিং থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক আসতে বাধা দেন। এসব ট্রাকের প্রতিদিনের ভাড়ার টাকা ছাড়াও বনগাঁ পৌরসভা চাঁদা নিচ্ছে। প্রতিদিন ছোট গাড়ি ৫০ টাকা, ছয় চাকা ৮০ টাকা, ১০ চাকা ১২০ টাকা ও ট্রেলার ১৬০ টাকা হারে পার্কিং চার্জ আদায় করে থাকেন। সিরিয়াল ভেঙে আগে গাড়ি বের করে দেওয়ার জন্যও বড় অঙ্কের টাকা নেওয়া হচ্ছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, সরকারিভাবে বা কাস্টমসের পক্ষ থেকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করা হয়নি। ট্রাক ড্রাইভারদের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে এমন অজুহাতে তৃণমূল কংগ্রেসের বনগাঁ উত্তরের সাবেক এমএলএ গোপাল শেঠ ও পৌর মেয়র শংকর আঢ্য ডাকু গুজব ছড়িয়ে জনগণকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে আন্দোলন করে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন।
বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক মামুন কবির তরফদার বলেন, ভারত থেকে দুই দিনে ১৫ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়েছে। নো-ম্যানসল্যান্ডে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিবিধান মেনেই পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট করা হয়েছে। ভারতের বনগাঁ এলাকার জনগণের আন্দোলনের জন্য পণ্য আমদানি হয়নি। পেট্রাপোল বন্দর থেকে পণ্য এলে বেনাপোল বন্দরের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
বন্দর সূত্র জানায়, কলকাতা থেকে বেনাপোলে সব ধরনের রেলকার্গো অবিলম্বে চালু করা যেতে পারে। এ-সংক্রান্ত স্থলবন্ধর কমিটি তদন্ত করে স্থলবন্দরের রেলকার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে দেখতে পায়। সাইডডোর ও এফসিএন কন্টেইনারও হ্যান্ডলিং করা সম্ভব বলে কমিটি সুপারিশ করে। এখন সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া ট্রাক প্রবেশ বন্ধ না করার বিষয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। অচলাবস্থার যাতে স্থায়ী না হয়, তার সমাধান হওয়া দরকার। আমদানিকারকের সামনে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিকল্প পণ্য ও বিকল্প দেশ উম্মুক্ত। বহু আমাদানিকারক বেনাপোল থেকে চট্টগ্রাম, মোংলা ও অন্যান্য বন্দরে চলে গেছেন।
সূত্র আরও জানায়, ভারত বাংলাদেশের প্রধান স্থলবাণিজ্য বন্দর বনগাঁর নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার হাতিয়ার হয়ে পড়েছে। স্বেচ্ছাচারিতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ৩৫ হাজার কোটি টাকা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কিছু লোভী ও দুর্বৃত্ত ব্যক্তির খামখেয়ালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে পারে না। অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দু’দেশের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মাফিয়ামুক্ত সুষম বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
দুই সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিন্ডিকেটমুক্ত সহজ ও সুষম বাণিজ্য নিশ্চিত করতে হলে কমলাপুর আইসিডির মতো শর্তহীনভাবে অবাধে সব রকম পণ্য রেলকার্গো ও কন্টেইনারে আমদানির বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কোনো প্রকার দেরি না করে বেনাপোল কাস্টম হাউস ও স্থলবন্দরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে হবে। এনবিআর এ নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছে বলে সূত্র জানায়।
সূত্র:শেয়ার বিজ, জুন ৭, ২০২০