রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক জনাব নাহিদ হাসান নলেজ। দীর্ঘ ১০ বছর থেকে কুড়িগ্রাম জেলার গণমানুষের সমস্যা ও কুড়িগ্রাম জেলার সম্ভাবনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে আসছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় কলামও লিখছেন কুড়িগ্রাম নিয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রেল নিউজ বিডি’র সম্পাদক আতিকুর রহমান।
রেল নিউজের পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলোঃ
রেল নিউজ বিডিঃ রেলের উন্নয়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কি বলে মনে করেন?
নাহিদ হাসান নলেজঃ স্বনির্ভর ও স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে না তোলার মানসিকতা। আর সেখান থেকেই আসে ভুল ও লুটপাটের দৃষ্টিভঙ্গী। অর্থাৎ আমদানি নির্ভর মানসিকতা। রাষ্ট্রকর্তা মানে রাজনীতিবিদদের নিয়তই হচ্ছে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। তারা নিজেরাই চান না রেল নিজের পায়ে দাঁড়াক। যদি চাইতেন তাহলে তাহলে বিশাল বাজেট দিয়ে বিশাল বিশাল স্টেশন ভবন নির্মাণ না করে রেলপথ ও কারখানা আধুনিক করতেন, এখানে অর্থ বরাদ্দ দিতেন। রেল লাইন ও ট্রেনের খবর নাই, স্টেশন নিয়ে এরা পড়ে আছেন। তার মানে যেটা দরকার সেটা করবেন না। তাহলে ঘর দিয়ে কী করবেন। টিকেট তো ছাপড়া ঘর থেকেও বিক্রি করা যায়, একটা টেবিল নিয়ে বিক্রি করা যায়। আসল কাম নাই নকল কাম নিয়া টানাটানি।
রেল নিউজ বিডিঃ বর্তমান রেলের যাত্রীসেবা নিয়ে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট?
নাহিদ হাসান নলেজঃ রমনা রুটে গত ৩০ বছর ধরে চেকার নাই, ডাবল লাইন না থাকায় ট্রেনের শিডিউল ঠিক থাকে না, গাড়ির গতি কম, টয়লেটের অবস্থা যাচ্ছে তাই। গাড়ির মধ্যে বাতি নাই, নোংরা পরিবেশ। যাত্রী সেবায় সন্তুষ্ট হবার কোনো কারণ নাই। টিকেটের দামও বেশি। ডেমুগুলোতে পঙ্গু ও বয়স্ক লোকের পক্ষে ওঠা কঠিন। তবুও আমরা রেল চাই, কারণ এখানে পা ছড়িয়ে বসা যায়। রেলের মালিক আমরা। দেশের সম্পদ।
রেল নিউজ বিডিঃ আপনাদের রেল আন্দোলনের সফলতা কি?
নাহিদ হাসান নলেজঃ আমাদের রেল আন্দোলনের প্রধান সফলতা গণজাগরণ। রেল যে জনগণের এই বোধটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। টিকেট চেকার নেই, তবু প্রচুর লোক স্বেচ্ছায় টিকেট কাটছেন। লুটপাটের সর্বগ্রাসী চক্রের মধ্যে নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ, এটাই আমাদের প্রধান সফলতা।
রেল নিউজ বিডিঃ বাংলাদেশের রেলের যাত্রী চাহিদা থাকা সত্বেও লোকসানের কারণ কি?
নাহিদ হাসান নলেজঃ লোকসানের আসলে কোনও কারণ নেই। একটি ইঞ্জিন যেখানে ২৫ টি বগি টানতে পারে সেখানে বগি লাগানো হয় ১০/১২ টি। এখানেই অর্ধেক লোকসান। এছাড়াও ডাবল লাইন না থাকায় ট্রেনজটের কারণে শিডিউল মেইনটেইন না করায় বড় অংশই ট্রেনে চড়েন না। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বাস মালিকদের সাথে অলিখিত গোপন লেনদেন। সে কারণে অফিস ছুটির দিনগুলোতে ইচ্ছাকৃত ব্যাপক শিডিউল বিপর্যয় ঘটানো হয়। এই হচ্ছে কারণ।
রেল নিউজ বিডিঃ রেলের উন্নয়নে গনমাধ্যম কি ভূমিকা রাখতে পারে?
নাহিদ হাসান নলেজঃ গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের ও সমাজের মুখ। রাষ্ট্র ছাড়া আমরা চলতে পারব, কিন্তু গণমাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণ কথা বলে, যে জনগণ অফুরন্ত সৃজনশীলতার উৎস। অনেক ঘটনাই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ জানতে পান গণমাধ্যমের মাধ্যমে। জনগণ গণমাধ্যমের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে মতামত জানাতে পারেন। গণমাধ্যমকেও তাই রেলবান্ধব হতে হবে। গণমাধ্যম সত্যিকারের গণমাধ্যম হলে রেলকে জনগণের রেলে পরিণত করা সম্ভব।
রেল নিউজ বিডিঃ বাংলাদেশের রেলওয়েতে কি কি পরির্বতন আনলে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে?
নাহিদ হাসান নলেজঃ ইউএনডিপি ও এসকাপ একটি গবেষণায় দেখিয়েছে সড়কপথে যেখানে খরচ ২১৭ টাকা, রেলপথে তা মাত্র ৮৫ টাকা আর নৌ পথে তা ২৫ টাকা। তাহলে আমরা কেন ভূমি নষ্ট করে সড়ক পথ বানাচ্ছি? কারণ যত প্রকল্প তত দাও মারার সুযোগ। যানজট আজ রাষ্ট্রব্যাপি সংকটের নাম, ফলে ব্যাপক কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। তেল খরচ বাবদ আমরা ব্যাপক ডলার খরচ করছি অথচ ট্রেন সোলারেও চলে। পণ্য পরিবহণ খরচ কমলেই জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়বে, সেটা রেল ছাড়া সম্ভব নয়। ট্রেন সুশৃঙ্খল জাতি নির্মাণ করে। পরিবেশ দূষণ ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধেও ট্রেন অনিবার্য বাহন। অর্থাৎ উন্নত রেল উন্নত জাতি নির্মাণের নিয়ামক। এখন উন্নত রেল ব্যবস্থা সম্ভব করতে হলে প্রথমত রেলের গতি বাড়াতে হবে। যেমন পুরো রেল লাইনের পাতগুলো মাটির বদলে কংক্রিটের ওপর স্থাপন করতে হবে। তাতেই ২শ কিঃমিঃ স্পীডে ট্রেন চলবে। দুর্নীতিমুক্তভাবে খরচ করা গেলে এখন যে বাজেট দেয়া হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে এত উন্নত রেলপথ বানানো সম্ভব। তারপর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট নারায়ণগঞ্জ-আখাউড়া হয়ে সংক্ষিপ্ত করতে হবে। তেমনি উত্তরবঙ্গের রুট কুড়িগ্রাম-জামালপুর হয়ে হতে হবে। অর্থাৎ উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত একটা শর্টকাট রেলপথ আমাদের বানাতে হবে। শুধু লুটপাট বন্ধ করলেই এই বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে উন্নত বিশ্বের রেলপথ আমরা পাব। সমভূমির বাংলাদেশ আমাদের জন্য বিশাল সৌভাগ্যের প্রতীক।
রেল নিউজ বিডিঃ কি কি কারণে আপনি রেল ভ্রমনকে স্বাচ্ছন্দ মনে করেন?
নাহিদ হাসান নলেজঃ নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনসমাগম বলে।
রেল নিউজ বিডিঃ রেলের উন্নয়নে জনগণর কি ধরনের সচেতনতা দরকার?
নাহিদ হাসান নলেজঃ প্রথমত, নিজেরা টিকেট কাটা দরকার। দ্বিতীয়ত, অন্যদেরও টিকেট কাটতে বলা উচিত। অভিযোগ খাতায় অভিযোগ নিজে লেখা ও অন্যদের লিখতে বলা উচিত। তাছাড়া মাল বুকিং ছাড়া মাল গাড়িতে তোলা হয় কিনা, এগুলো খেয়াল রাখা দরকার। সমস্যা দেখলে গার্ডকে অভিযুক্ত করা এবং অন্যান্য ত্রুটি দেখলে তথ্য প্রমাণসহ ফেসবুকে প্রচার করা। এছাড়াও কন্ট্রোলারসহ অন্যদের নম্বরগুলো যোগাড় করে রাখা উচিত, ত্রুটি দেখলেই স্বাক্ষী প্রমাণসহ অবগত করা। আর সবাইকে রেল যাত্রায় উৎসাহী করা উচিত।
রেল নিউজ বিডিঃ রেলের উন্নয়নে আপনার পরামর্শ কি?
নাহিদ হাসান নলেজঃ সকল রেল লাইনকে ডাবল লাইন করতে হবে এবং কারখানাগুলোকে আধুনিক করতে স্টেশন নির্মাণ স্থগিত রেখে ওই টাকা কারখানায় বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে আগামি ১০ বছরেই উন্নত বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা পেয়ে যাব।
রেল নিউজ বিডিঃ আন্দোলনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
নাহিদ হাসান নলেজঃ একটি আন্দোলন যদি গণলাইন বজায় রাখতে পারে, সত্যিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণ হয়ে ওঠে তার বিকাশ ঘটবেই। নেতৃত্ব যে কোনও ঘটনা না, এটা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আমরা দেখেছি, সংগঠন যেসব উপজেলায় জনগণের ২/৫ টাকায় কর্মসূচি পালন করেছে, সংগঠন সেখানে তত শেকড় ছড়িয়েছে। আর যেখানে কয়েকজন ব্যক্তির অর্থ সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়েছে সেখানে নেতৃত্ব ও সংগঠন বিকশিত হয়নি। আমাদের নেতারা সবাই নিম্ন শ্রেণী থেকে আসা মানুষ। আমাদের কেউ অতীতে কখনও বিশেষ সম্মান পাইনি। কিন্তু এই আন্দোলন করতে গিয়ে দেখেছি হোটেলে ওয়েটার, মালিকরা বিশেষ যত্ন করেছেন। জেলা সদরের সুজা নামের একজন কর্মি আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, কীভাবে ব্যাংকে তাকে সমাদর করা হয়েছে। ব্যাংকের কর্মচারিরা তাঁকে আন্দোলনটার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমাদের পোস্টার ও লাগানো গাছকে সকলে নিজেদের গাছ বলে যত্ন করেন। গণকমিটি লক্ষ লক্ষ লিফলেট আন্দোলনকালে ছড়িয়েছে, কিন্তু আমাদের লিফলেট মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে নাই। সাধারণ মানুষ যে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অসাধারণ হয়ে ওঠে তার বেশ কিছু নজির আছে। ৯০ ভাগ দৃষ্টান্ত আমার চোখের আড়ালে ঘটেছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। চিলমারীর রমনা ঘাটের, পাঁচপীর স্টেশনের, উলিপুর, কুড়িগ্রাম স্টেশনের যেকোন স্টেশনে আপনি চা খাবেন, কিন্তু পয়সা যদি না থাকে গণকমিটির পরিচয় দিলে কিছু বলবে না দোকানি। এর চেয়ে বড় পাওয়া কিছু আছে বলে আমি জানি না। কতজনের বন্যায় বাড়ি ভেসে গেছে তবুও গণকমিটির মিছিলে থেকেছে, নাম নিচ্ছি না কারও বাদ পড়ার ভয়ে। কতজন শরীরে জ্বর ও পরীক্ষা নিয়েও রাতে পোস্টার লাগিয়েছে, কতজন পুলিশী ঝামেলায় পড়েও দেয়াল লিখেছে, কতজন গণকমিটির মিটিং বলে ভোরে বাড়ি ও মেস থেকে রওনা দিয়েছে, কেউ কেউ টাকা ধার নিয়ে ১শ কিঃমিঃ দূরে মানববন্ধনে হাজির হয়েছে। খোদার কসম, সবচেয়ে কম পরিশ্রম করেছি আমি। সবাই মিলে আমাকে ছাড় দিয়েছে, সেবা দিয়েছে। আর লাইম লাইটে এসেছি আমি। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত। এই সুবিধাবাদিতার সমাধান হওয়া উচিত। সবচেয়ে কম ত্যাগ আর বেশি ভোগ!
রেল নিউজ বিডিঃ কুড়িগ্রামবাসী আন্ত:নগর ট্রেন কবে পাবে?
নাহিদ হাসান নলেজঃ প্রধানমন্ত্রী জানেন।