ইসমাইল আলী: ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বর্তমানে বছরে ৬১ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার বা ৫৫ শতাংশ যাত্রী বাসে যাতায়াত করে। আর ট্রেনে যাতায়াত করে ১৬ লাখ ৪৭ হাজার বা ২৭ শতাংশ যাত্রী। তবে ২০৪১ সালে এ চিত্র পুরো পাল্টে যাবে। সে সময় ৫৩ শতাংশ যাত্রী ট্রেনে চলাচল করবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। আর ১৮ শতাংশ যাত্রী বাসে যাতায়াত করবে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ‘কমপ্রিহেনসিভ ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বিটুইন ঢাকা অ্যান্ড চিটাগাং’ শীর্ষক পরিকল্পনার অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০৪১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন চাহিদা এবং তা পূরণে করণীয় নির্ধারণে পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করছে জাইকা। সম্প্রতি এর অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। জাইকার অর্থায়নে পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করছে জাপানের পাডিকো কোম্পানি লিমিটেড।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বর্তমানে বছরে ৬১ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এর প্রায় ৬০ শতাংশ বা ৩৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষের যাতায়াত সড়কপথনির্ভর। আর বাসে যাতায়াত করে ৩৩ লাখ ৫০ হাজার। বাকিরা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করে। তবে বাসে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে বেসরকারি পরিবহন কোম্পানির আধিপত্যই সবচেয়ে বেশি। এ রুটে চলাচলকারী প্রায় ৯৯ শতাংশ বেসরকারি বাস। অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে প্রায় ৫০টি কোম্পানি এ রুটে বাস পরিচালনা করে থাকে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রী পরিবহনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রেলপথ। এ পথে বছরে বর্তমানে ১৬ লাখ ৪৭ হাজার বা ২৭ শতাংশ যাত্রী যাতায়াত করে রেলপথে, যদিও এ রুটে ট্রেনের অনেক চাহিদা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে দৈনিক মাত্র চারটি আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে পরিচালনা করে। আর এ রুটে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার আকাশপথে ও এক লাখ ৮৩ হাজার নৌপথে যাতায়াত করে।
এদিকে ২০৪১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রী চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে তিনগুণের বেশি। সে সময় রুটটিতে বছরে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ যাতায়াত করবে।
এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ বা প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ যাতায়াত করবে রেলপথে। রুটটিতে যাতায়াতে এর পরই ব্যক্তিগত গাড়িতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে যাত্রীরা। ফলে সে সময় প্রায় ২০ শতাংশ বা ৩৮ লাখ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে। আর বাসে যাতায়াত সে সময় অনেক কমে যাবে। মাত্র ১৮ শতাংশ বা প্রায় ৩৪ লাখ মানুষ এ রুটে সে সময় বাসে যাতায়াত করবে, যা বর্তমান সময়ের চেয়েও কম। এছাড়া ২০৪১ সালে আকাশপথে ১৩ লাখ ও নৌপথে ছয় লাখ মানুষ যাতায়াত করবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আরামদায়ক ভ্রমণ ও দ্রুতগতির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূরপাল্লার যাতায়াতে ট্রেনকেই বেশি পছন্দ করে যাত্রীরা। শুধু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। এ দেশে ট্রেনের গতি অনেক কম। আবার বিদ্যমান রুটও অনেক জটিল ও অনেকটা ঘুরপথ। চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনের টিকিটও পাওয়া যায় না। এছাড়া বাসে এ রুটে যাতায়াতে সময় কম লাগে। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বাসের প্রাধান্য বেশি। তবে ভবিষ্যতে গতি ও ট্রেনের সংখ্যা বাড়লে অবশ্যই রেলপথ জনপ্রিয় হবে।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাতায়াতে ২০৪১ সালে রেলপথকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণও উঠে এসেছে কমপ্রিহেনসিভ ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে। এতে বলা হয়েছে, ২০৪১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে চালু হবে। আবার এক্সপ্রেস রেলপথও চালু হবে। এতে ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে মাত্র তিন ঘণ্টা। আর ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া যাবে সাড়ে চার ঘণ্টায়। তবে এক্সপ্রেসওয়েতে টোল থাকায় বাসগুলো তা পরিহার করে চলবে। এতে বাসে যাতায়াতে সময় খুব বেশি কমবে না। বাসে ছয় ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগবে যাতায়াতে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাতায়াতে সে সময় ট্রেনে ভাড়া পড়বে দুই হাজার ৪০০ টাকা, বাসে এক হাজার ২৫০, ব্যক্তিগত গাড়িতে চার হাজার ও বিমানে চার হাজার ৪৭০ টাকা। তবে এ রুটের উন্নয়নে বেশকিছু জটিলতাও তুলে ধরা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রকল্প গ্রহণে দ্বৈততা। যেমন: ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক বিভাগ। আর সেতু বিভাগ এ রুটে এক্সপ্রেস সড়ক ও রেলপথ নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করতে যাচ্ছে। অথচ এক্সপ্রেস রেলপথ নির্মাণে পৃথক সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে রেলওয়ে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে রেলপথে যাতায়াতে সময় লাগে পাঁচ-সাত ঘণ্টা। বর্তমানে এ রুটে দৈনিক চার জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন যাতায়াত করে, যদিও চাহিদা অনেক বেশি। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে রেলপথে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এটির রুট ঘুরানো পথ। অর্থাৎ ট্রেন ঢাকা থেকে সরাসরি চট্টগ্রামের পথে না গিয়ে উল্টোপথে টঙ্গী-ভৈরববাজার হয়ে লাকসাম যায়। এর পর সোজা পথে চট্টগ্রাম যায়। ফলে ২১০ কিলোমিটার পথ ট্রেনে যেতে ৩২০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। এছাড়া ট্রেনের গতিও অনেক কম। এ রুটে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলে ট্রেন। তবে ডাবল লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলে এ সক্ষমতা তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে।
এদিকে বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বাসে যাতায়াতে সময় লাগে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। তবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে সড়কপথে যাতায়াতে বড় বাধা হলো কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু। তবে চার লেনের কারণে বাকি অংশ দ্রুত যাতায়াত করা যায়। আর বিমানে যাতায়াতে সময় লাগে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা। তবে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে বিশেষ করে ঢাকা শহরে কয়েক ঘণ্টাও লেগে যায়। বিমানে যাতায়াত জনপ্রিয় না হওয়ার এটি বড় কারণ।
সড়কপথের বেশকিছু সমস্যাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, সড়কপথে যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা অনেক কম। কারণ প্রবেশ সংরক্ষিত বা কোনো এক্সপ্রেসওয়ে নেই। ফলে একই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল করে। এছাড়া সড়ক ও সেতু সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণও করা হয় না। সড়ক নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। আবার প্রচুর ওভারলোডেড পণ্যবাহী যান চলাচল করে এ রুটে। সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাও নেই ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে।
সুত্র:শেয়ার বিজ