।। নিউজ ডেস্ক ।।
দেড়শ বছরের পুরোনো রেলওয়ে রানিং স্টাফদের মাইলেজ পদ্ধতি। ১৮৬২ সাল থেকে এ সুবিধা দিয়ে আসছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে এ সংস্থাটির বিভিন্ন ভাতা ভিন্নতর হওয়ায় জটিলতার মুখে পড়েছে রেলওয়ে। এনিয়ে প্রতিনিয়তই আন্দোলন করছেন রেলওয়ে রানিং স্টাফরা। তারা বলছেন, এটি তাদের অধিকার। তাদের মধ্যে এখন তৈরি হয়েছে ন্যায্য পাওনা না পাওয়ার শঙ্কা।
সর্বশেষ ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলন্ত ট্রেনে দৈনিক ১০০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করলেও ওই দিনের বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি মাইলেজ ভাতা পাবেন না সংশ্লিষ্ট রানিং স্টাফ। আর মাস শেষে এই মাইলেজ মূল বেতনের বেশি হবে না। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা।
জানা গেছে, রেলওয়ের সংস্থাপন কোডের বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক রানিং স্টাফ এবং লোকোমোটিভ রানিং স্টাফদের ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে মূল বেতনের ভিত্তিতে রানিং অ্যালাউন্স প্রদানের প্রস্তাব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানিং স্টাফদের বিশেষ এ ভাতা প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু সম্প্রতি ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে বিশেষ ভাতা সীমিত হয়ে যাওয়ার ঘোষণা মানতে পারছেন না রানিং স্টাফরা।
রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), গার্ড ও টিকিট চেকাররা (টিটি)। বর্তমানে ট্রেন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন ও স্বাভাবিক রাখতে এসব রানিং স্টাফের দৈনিক নির্ধারিত ১২ কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকজনের লোকোমাস্টারের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, সুবর্ণ এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে সকাল ৭টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কিন্তু লোকো মাস্টারকে (ট্রেন চালক) উপস্থিত হতে হয় ভোর ৫টায়। এর আগে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ভোর ৪টায় ফোন করে ঘুম থেকে ডেকে দেন। লোকোমাস্টার ইঞ্জিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ৬টায় স্টেশনে আসেন। লোকোমাস্টারকে অবশ্যই ৭টায় ট্রেন ছাড়তে হবে। এ ট্রেন ছাড়তে যদি এক মিনিট দেরি হয়, তখন তাদেরকেই জবাবদিহি করতে হয়।
তারা আরও বলেন, ‘ট্রেন ঢাকায় পৌঁছানোর পর ইঞ্জিন শেডে রেখে দিতে হয়। সেখানে সব ঠিকঠাক করে দিতে ১ ঘন্টা সময় লাগে। এরপর সব বুঝিয়ে দিয়ে নিজের টাকায় নাস্তা-খাবার খেয়ে পরের দিন আবারও অন্য ট্রেন নিয়ে চট্টগ্রাম আসতে হয়। এ সময়ের মধ্যে খাবার-নাস্তাসহ যে টাকা খরচ হয় সেটা যেহেতু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বহন করে না, তাই আমরা মাইলেজ পাই’।
‘একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ডিউটি শেষে পরবর্তী ১৬ ঘন্টা বিশ্রামে যেতে পারেন বা ব্যক্তিগত কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু একজন লোকোমাস্টারকে ডিউটি শেষ করার পরেও সবসময় অতিরিক্ত ডিউটির জন্য তৈরি থাকতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ফোন পাওয়া মাত্রই সাড়া দিতে হয়। মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঈদ-পূজার ছুটির সময় লোকোমাস্টারকে ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। তাদের কোনও ছুটি নেই। সেই বিবেচনায় বৃটিশ আমল থেকেই লোকমাস্টাররা মাইলেজ পান’।
মাইলেজ কি?
সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ট্রেন চালকদের (রানিং স্টাফ) যে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় সেটিকে বৃটিশ আমল থেকে ‘মাইলেজ’ নামে অবহিত করা হয়। এছাড়াও রানিং স্টাফরা প্রতি ৮ ঘন্টা কাজ করার পর জন্য ১ দিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ যে অর্থ প্রদান করা হয় তা-ই মাইলেজ।
মালবাহী ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে মালামাল লোড করে আখাউড়া যায়। সেটি পৌঁছাতে মাঝে মধ্যে ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগে। এ সময়ে লোকোমাস্টারকে ইঞ্জিনেই বসে থাকতে হয়। কারণ এ ট্রেনগুলোর কোনও নির্দিষ্ট শিডিউল থাকে না।
সংকটের মধ্যেও তারা
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলী ব্রেকে ২৩৪ জন চালক থাকার কথা। কিন্তু সেখানে আছে ১৬৬ জন। এর মধ্যে প্রধান ট্রেন চালক (লোকোমাস্টার) রয়েছেন ১০১ জন। সহকারী চালক ১১৩ জন। সাব লোকোমাস্টার রয়েছেন ২০ জন। চাহিদার তুলনায় অর্ধেক চালক দিয়ে চালাতে হচ্ছে ট্রেন।
রেলওয়ের নিয়োগে লোকোমাস্টারদের (চালক) অবশ্যই এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগের সনদ থাকতে হয়। এছাড়া নিয়োগ পাওয়ার পর তাদের এক বছরের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতেও পাস করতে হয়। যদি কেউ সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারে, তখন তার চাকরি স্থায়ী হয় না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মজিব বলেন, রেলওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬২ সালে। ওই সময় থেকে রেলওয়ে অ্যাক্ট অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছেন রানিং স্টাফরা। হঠাৎ করে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যেখানে আমাদের বেতন-ভাতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়মে নির্ধারিত সময়ের পর কর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেবেন। এতে বিঘ্ন হতে পারে রেলের স্বাভাবিক চলাচল। এ ব্যাপারে রেল মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। রেলমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক আব্দুল বারি বলেন, মাইলেজ হলো ‘পার্ট অব পে’। কাজ করলেই পাই, না করলে পাই না। এটি বৃটিশ আমল থেকে চালু।
‘একজন রানিং কর্মচারী রেলওয়ে স্টাবলিশমেন্ট কোড ভলিয়ম-১ এর চ্যাপ্টার-৫ এবং লোকোমোটিভ অ্যান্ড রানিং শেড ম্যানুয়াল জিআই চ্যাপ্টার-১২ অনুযায়ী ১০০ মাইল বা প্রতি ৮ ঘণ্টা ট্রেন পরিচালনার জন্য একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ রানিং ভাতা বা মাইলেজ প্রাপ্য হবেন। সাপ্তাহিক ও সরকারি যে কোনও বন্ধের দিনে ডিউটি করলে ‘হলিডে মাইলেজ’ প্রাপ্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে আমরা বিব্রত। আমরা কষ্ট করি, সে কষ্টের মূল্যায়ন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে গেছেন। তার সুযোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিচ্ছেন’।
বাংলাদেশ শ্রমিকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে রেলওয়ে রানিং কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়েতে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় রয়েছে যা অর্থ মন্ত্রণালয় উপলব্ধি করতে পারছে না। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন দেওয়ার আগে আরও দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
সূত্রঃ বাংলানিউজ২৪