ছয় কারণে কাটা পড়ছে মানুষ * বছরে সারা দেশে ২১০০ জন ও ঢাকায় ৫০০ জনের মৃত্যু * হেডফোনের কারণে মৃত্যু ৪৩০ জনের
শিপন হাবীব:
দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু থামছে না। ২০১৭ সালে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে। রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটা, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করা, তাড়াহুড়া করে রেলক্রসিং পার হওয়া এবং চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এছাড়া চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা তো আছেই।
রেলওয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের তথ্য- রাজধানীতে এক বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। শীতকালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। শীতকালে কান ঢাকা থাকায় ট্রেনের হর্ন শুনতে না পারা এবং কুয়াশার জন্য ট্রেনের লাইট দেখতে না পারায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় তিন বছরে ৪৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাঁচ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, লাশ উদ্ধার এবং লাশের ধরন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে রেলওয়ে পুলিশ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এক শ্রেণীর মানুষ কখনও জেনে, কখনও চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ‘বাহাদুরী’ ও ‘সেলফি’ তুলতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে তরুণ-তরুণীরা হাঁটতে গিয়েও অহরহ প্রাণ হারাচ্ছে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেছেন, ট্রেন বা রেললাইনে কাটা পড়ে সম্ভবত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। লাইন দিয়ে হরহামেশা সব শ্রেণী-পেশার মানুষ হাঁটে। রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ, দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু লাইন নয়, লাইনের দুই পাশ (১০ ফুট করে) ১৪৪ ধারা জারি থাকে। রেললাইন ধরে না হাঁটতে তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান।
প্রতি বছর ট্রেনে কাটা পড়ে বহু লোক প্রাণ হারাচ্ছে জানিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে জানান, অসচেতনতার অভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে লোকজন অহরহ প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ আবার পঙ্গুত্ববরণ করছেন। ট্রেন নিজস্ব পথে চলে। সেই পথ কোনো অবস্থাতেই মানুষের হেঁটেচলা রাস্তা বা পথ হতে পারে না। রেললাইন ঘিরে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত কর্তৃপক্ষ সচেতনতামূলক বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু রেললাইনের অংশ দখল, কাঁচাবাজার বসানো এবং অবৈধ রাস্তা তৈরি করে রেললাইন ঘেঁষে চলাচলা করা হচ্ছে। রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটছে মানুষ। তিনি বলেন, আইন দিয়ে নয়, সাধারণ মানুষ সচেতন হলে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।
নওগাঁর বাধাইমুড়ি এলাকায় মঙ্গলবার মনছুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান। শুক্রবার গৌরীপুর এলাকায় অজ্ঞাত এক শিশু, শনিবার নরসিংদীতে জাহিদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি, রোববার রাজধানীর বনানী ও মহাখালী এলাকায় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় তারা মৃত্যুর শিকার হয়। বৃহস্পতিবার কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রেললাইন ধরে হাঁটার সময় রায়হান নামে এক যুবক ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হয়। তার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শান্ত্বনা বসাক ও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান। তিন বছরে কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় ৪৩০ জনের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ।
গত বছর রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে জীবন হারান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন মোল্লা। ১১ সেপ্টেম্বর নবদম্পতি আরিফুল ইসলাম (২৩) ও হাসিনা বেগম (১৮) ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান। ৩ সেপ্টেম্বর নরসিংদী শিবপুরে মোবারক হোসেন ও অজ্ঞাত এক মহিলার মৃত্যু হয়। গত বছর ট্রেনে কাটা পড়ে রাজধানীর নীলক্ষেতে জহিরুল ইসলাম ও অস্টেলিয়া প্রবাসী সৌরভ পাল মারা যান। বনানী এলাকায় বুয়েটের শিক্ষার্থী তানভীর গওহর তপু ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান। গত বছর ভালোবাসা দিবসে যশোরে বান্ধবীকে নিয়ে ‘হেডফোন’ কানে দিয়ে আজাদ (২২) নামে এক যুবক রেললাইন ধরে হাঁটার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়। দুই বছর আগে নববধূর সঙ্গে হেডফোনে কথা বলতে বলতে মালিবাগ এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ওয়াজিউল্লাহ নামে এক ব্যক্তি।
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াছিন ফারুক যুগান্তরকে বলেন, লাইন ঘেঁষে পড়ে থাকা লাশ উদ্ধার করতে রেলওয়ে পুলিশকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রতিনিয়ত লাশ উদ্ধার করতে হয়। অধিকাংশ লাশের পরিচয় পাওয়া যায় না। গত বছর শুধু রাজধানীতে ট্রেনে কাটা পড়ে ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া তিন বছরে রাজধানীতে কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় ৯০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ছয় কারণে ট্রেনে কাটা পড়ছে মানুষ। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- রেললাইন দিয়ে হাঁটা, লাইনের ওপর বসে গল্প করা, লাইন পার হওয়ার সময় বা লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় মোবাইল ফোন ও হেডফোন ব্যবহার করা, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা, সেলফি কিংবা বাহাদুরী দেখাতে ট্রেনের নিচে শুইয়ে পড়া।
রেলওয়ে পুলিশ বলছে, ব্রিটিশ শাসনামলের ১৮৬১ সালের পুরনো আইনে রেল চলছে। এ আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ এমনকি গবাদিপশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেফতার করা যায়। সরেজমিনে ঢাকার কারওরানবাজার রেলক্রসিংয়ের দুইপাশে কয়েকশ’ মানুষকে রেললাইন ধরে হাঁটতে দেখা যায়। ট্রেন আসার ঘণ্টি পড়লেও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। রেললাইন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারও কোনো লক্ষণ নেই। ট্রেন কয়েক সেকেন্ডের দূরত্বে আসার পর একে একে সবাই পাশে দাঁড়াতে শুরু করল।
প্রতিদিনই সাধারণ লোকজন ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন জানিয়ে রেলওয়ে রেঞ্জের অতিরিক্ত আইজিপি মো. আবুল কাশেম যুগান্তরকে জানান, ট্রেনে কাটা পড়া বিষয়ে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ।
আইজিপি মো. আবুল কাশেম বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অনেক কারণের মধ্যে ভয়ঙ্কর কারণও পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, তরুণদের কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনে শুইয়ে থাকার চ্যালেঞ্জ করে। একজন চলন্ত ট্রেনের নিচে শুইয়ে পড়লে অন্যরা তা ভিডিও করে। এমন ভয়ঙ্কর একাধিক ভিডিও পুলিশ সংগ্রহ করেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। অপরদিকে চলন্ত ট্রেন ঘেঁষে সেলফি তুলতে গিয়েও হরহামেশা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তরুণরা। গত বছর ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া একসঙ্গে তিন শিশুর করুণ মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, রেললাইন ঘেঁষে কাঁচাবাজার, বস্তি, দোকানপাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের খেলা চলে।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে হাঁটা ও সেলফি তোলা। তিনি বলেন, প্রায় প্রতি সপ্তাহে সচেতনতার অংশ হিসেবে ট্রেনে ও স্টেশনগুলোতে লিফলেট বিতরণ করা হয়। রেললাইনে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পুনরায় রেললাইন দখল করা হচ্ছে। রেললাইন দিয়ে হাঁটা বন্ধ করতে না পারলে এমন মৃত্যু বন্ধ করা যাবে না।
সুত্র: যুগান্তর,০৫ জানুয়ারি ২০১৮